শুরু করেছিলেন আরমানীটোলার রজনী বোস লেনের একটি মেসবাড়িতে। শেষ ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক। এর মাঝখানে ঢাকায় আরও কয়েকটি বাড়িতে কেটেছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় এসে রাজনৈতিক জীবন শুরু করার পর বসবাসের জন্য বঙ্গবন্ধুর কোনো বাসস্থান ছিল না। ট্রেন থেকে ফুলবাড়িয়া নেমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন ১৫০ মোগলটুলীর দলীয় কার্যালয়ে। সেখানে আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দী সমর্থিত মুসলিম লীগের একটি ক্যাম্প অফিস ছিল। দূর-দুরান্ত থেকে আসা কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সেখানে। অফিস সচিব শওকত আলী এ দিকটা সামলাতেন। শেখ মুজিবুর রহমানও তার কল্যাণে ক্যাম্প অফিসে থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা পেলেন। এভাবেই মুজিবের ঢাকাই জীবন শুরু।

ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর মেস জীবন
এরপর শুরু হয় তার মেস জীবন। সেটাও নিজের ভাড়া করা মেসে নয়, ফুফাত ভাই মমিনুল হক খোকার মেসে। খোকা পুরান ঢাকার আরমানীটোলার রজনী বোস লেনের একটি মেসবাড়িতে বসবাস করতেন। একদিন সেখানে উঠে যান বঙ্গবন্ধু। একটি চৌকিকে ভাগাভাগি করে থাকতে শুরু করেন। কাঁথা-বালিশ-চাদর সবকিছুই ফুফাত ফাইয়ের কেনা।

শেখ মুজিব ভাবলেন, ক্যাম্প অফিস কর্মীতে ঠাসাঠাসি। তাই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তার মেসে থাকার সিদ্ধান্ত। তাদের দলে এমন অনেক কর্মী রয়েছেন, যাদের সামর্থ্য নেই মেসে থাকার, আবার এমন কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবও নেই, যাদের কাছে তারা থাকতে পারেন।
মমিনুল হক খোকার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের দিকে শেখ মুজিব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহচর জালাল উদ্দিন মোল্লা এবং আবদুল হামিদ চৌধুরীকে নিয়ে আরমানীটোলার ৮/৩ নম্বর রজনী বোস লেসের মেসে চলে আসেন।
টুঙ্গিপাড়া থেকে মাঝেমধ্যে স্ত্রী ফজিলাতুনন্নেসা ওরফে রেনুও সেখানে এসে সবাইকে অবাক করে দিতেন। শেখ মুজিব যা যা পছন্দ করতেন, সবকিছুই ব্যাগভর্তি করে নিয়ে আসতেন রেনু।
রজনী বোস লেনের ছোট বাসাটি এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক ঘটনাবহুল দিনের সাক্ষী হয়ে আছে। কেউ কেউ মনে করেন, রজনী বোস লেনের আগে বঙ্গবন্ধু কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের এক মেসে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। ফলে ঢাকায় ওটাই মুজিবের প্রথম ঠিকানা।
মমিনুল হক খোকা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মেঝ ফুফুর ছেলে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা ছিল তার পৈত্রিক বাড়ি। মুজিবের পরিবারের সঙ্গে তিনি আজীবন ছায়ার মতো থেকেছেন। নিঃস্বার্থভাবে পরিবারটিকে আগলে রেখেছিলেন। শেখ মুজিব রাজনৈতিক কারণে জীবনের বড় একটা অংশ জেলে কাটিয়েছেন। এ দুঃসময়ে তিনি পুরো পরিবারের অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনা, শেখ কামাল ও শেখ রেহানাকে স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন স্থানীয় অভিভাবক হিসাবে।
অস্তরাগের স্মৃতি সমুজ্জ্বল: বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি শিরোনামের বইতে মমিনুল হক খোকা স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে: ‘রজনী বোস লেনের মেসবাড়িটি ছিল শেখ মুজিবের মিনি অফিস। তখনকার সময় তাঁর অনেক রাজনৈতিক সহকর্মী সেখানে যেতেন। তারা গোপন সভায় মিলিত হয়ে সাম্প্রদায়িক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও এ দেশীয় এজেন্টদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার পথ খুঁজতেন।’
রজনী বোস লেনের এই ছোট কক্ষটি এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বড় সাক্ষী। বঙ্গবন্ধুর ঢাকার রাজনৈতিক জীবনের অনেক ঐতিহাসিক উপাদান ওই কক্ষ ও তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
তেমন একটি উপাদান ‘অবনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। মেস বাড়ির অদূরে আরমানীটোলা বটতলায় ছিল এটির অবস্থান। সেখানে শেখ মুজিব নিয়মিত আড্ডা দিতেন। সেই আড্ডায় মিলিত হতেন তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী হাফেজ মুসা, শওকত আলী, ইয়ার মোহাম্মদ খান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আতাউর রহমান খানসহ আরো অনেকে। চলত বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি চা-নাস্তা খাওয়া। সেখানকার হালুয়া, লুচি, রসগোল্লা ও গরম ডালপুরি ছিল বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয়।
অবনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছেই ছিল হাফেজ মুসার বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। পরবর্তী জীবনে তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। যখনই শুনতেন মুজিব অবনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এসেছেন, তিনি দৌড়ে সেখানে হাজির হতেন। ‘আদি ঢাকাইয়া’ এ মানুষটির ছিল দরাজ আত্মা। তিন প্রয়াত মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফের আত্মীয় ছিলেন। ১৯৫৪ সালে বন্যার সময় বঙ্গবন্ধু স্ত্রী-সন্তানসহ তার বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন।

ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, রজনী বোস লেনের মেসবাড়িটি ছিল শেখ মুজিবের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। এ মেসে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রিত্ব লাভ করেছিলেন। এটা ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের ‘ইউ টার্ন’।
মেসের ছোট কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগপন্থি নেতা মোহাম্মদ খান লুন্দখোর কিছুদিন অতিথি হিসেবে থেকেছিলেন। মেসে থেকে তিনি অনুভব করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা কত দীনহীনভাবে জীবন যাপন করে মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমেদ এই মেসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতেন।
এ-বাড়ি ও-বাড়ি
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেগুনবাগিচায় সরকারি বাসভবনে ওঠেন। বেশিদিন থাকা হয়নি সে বাসায়। সরকার গঠনের ৫৬ দিনের মাথায় তা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। তখন তার পরিবারকে সরকারি বাসভবন থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়।
তখন পরিবারটির মাথার উপর ছাদ তো দূরের কথা, কোনো খড়কুটোও নেই। তারা এখানে-সেখানে ঘুরতে থাকেন। অবশেষে ঠাঁই পান নাজিরাবাজারে মোহাম্মদ হানিফের বাসায়। মাত্র তিন দিনের নোটিশে তাদেরকে সরকারি বাসভবন ছাড়তে হয়েছিল। এরপর আওয়ামীলীগ নেত্রী আমেনা বেগমের সহযোগিতায় এক নির্মাণাধীন বাড়িতে তাদের উঠতে হয়। কিন্তু নির্মাণকাজের নানা ঝামেলা, লোহালক্কর ভাঙ্গার আওয়াজ ও হাতুড়িপেটার বিকট শব্দের কারণে তারা বেশিদিন সেখানে থাকতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধু তখন জেলে থাকায় অনেক বাড়িওয়ালা তার পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিতেন না, মূলত পুলিশি হয়রানির কারণে। সেগুনবাগিচায় বাসা ভাড়া নিতে গেলে একজন জজ পর্যন্ত তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। এমনকি তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম গ্যারান্টর হওয়ার পরও তারা বাসা ভাড়া পাননি।
গ্যারান্টর হয়ে জহুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের পরিবারকে বাসা ভাড়া দিলে কোনো অসুবিধা হবে না। তাদের সব দায়িত্ব আমার। তারা নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করবেন। না করলে তাদের ভাড়া আমি পরিশোধ করব।’
পরে মুসলিম লীগের নেতা ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নে আজিজুল হক নান্না মিঞার অনুরোধে সেই জজ সাহেব সেগুনবাগিচার বাসা ভাড়া দিয়েছিলেন। নান্না মিঞা শেখ মুজিবের বিপরীতমুখি রাজনীতি করলেও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
শুধু বাসা ভাড়া নয়, শেখ মুজিবের সন্তানদের পড়াশোনারও অনেক বিঘ্ন ঘটে তখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। পাকিস্তানের দোসররা বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের পড়াশুনার পথ রুদ্ধ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা-তদবির চালায়। এমনকি তাদেরকে কোনো স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি নিত না।
তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনেও। পাকিস্তানি শাসকদের ভয়ে যখন কোনো স্কুল তাকে ভর্তি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তখন এগিয়ে আসেন কবি সুফিয়া কামাল। তিনি থাকতেন টিকাটুলীতে। সেখানকার ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি শেখ হাসিনাকে সেখানে ভর্তি করে দেন। বিপ্লবী নীলা নাগের প্রতিষ্ঠিত স্কুল নারী শিক্ষা মন্দির হয়ে শেখ হাসিনা কামরুননেসা গার্লস স্কুল, আজিমপুর গার্লস স্কুল হয়ে ইডেনে পড়াশুনা করেছিলেন। সে সময় শেখ কামাল ও জামাল ভর্তি হয়েছিলেন শাহীন স্কুলে।
পাকিস্তানের ২৫ বছরে শেখ মুজিবকে ১৪ বছরই জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছিল। এ সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এবং তার সন্তানদের কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল। তার স্ত্রীর সংগ্রামী জীবন ছিল একটি অনুকরণীয় বিষয়। একজন বাঙালি নারী কতটা সহনশীল আর আদর্শ চরিত্রের হতে পারেন, এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হলেন তিনি। তার জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করলেই সেটা বুঝা যাবে।
বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। সিদ্ধেশ্বরীতে বাসা ভাড়া নিতে গেলেন বেগম মুজিব। সেখানে গিয়ে তিনি এক অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হলেন। সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল মাঠের পাশে এক পুলিশ অফিসারের বাসা ভাড়া নেন মাসিক ২০০ টাকায়। শেখ মুজিবের পরিবারকে বাসা ভাড়া দেওয়াতে পাকিস্তানি প্রশাসনের উপর মহল থেকে বাড়িওয়ালাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। বাড়ির মালিক অনেকটা বাধ্য হয়েই সে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। বেগম মুজিব তখন ঘটনাটি কবি সুফিয়া কামালকে জানান। তখন তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়িওয়ালাকে শেখ মুজিবের পরিবারকে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার অনুরোধ করেন। কারণ সেখানে একটি বাসা তখন খালি ছিল। কিন্তু বাড়িওয়ালা তাদের পরিচয় জেনে আর বাসা ভাড়া দিতে রাজি হননি। অবশেষে প্রখ্যাত কংগ্রেসনেতা ও মন্ত্রী আশরাফ আলী চৌধুরীর সহযোগিতায় তাদের জন্য ৭৬ নম্বর সেগুন বাগিচায় ৩০০ টাকা ভাড়ায় একটি বাসা জোগাড় করা হয়।
৩২ নম্বরে এক বিঘার প্লট
মূলত এমন সীমাহীন হয়রানি আর দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের প্লটে বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন বেগম মুজিব। ১৯৬০ সালের দিকে শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বেগম মুজিব বলেন, পাকিস্তানি শাসক এবং এদেশীয় দোসর-দালালদের ভয়ে তাদেরকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। দিলেও পরে উঠে যেতে বলে। ফলে আশ্রয়ের জন্য এখানে-সেখানে ঘুড়ে বেড়াতে হয়। এতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় বেশ বিঘ্ন ঘটছে।
এসব কথাবার্তা বলে বেগম মুজিব বরাদ্দ পাওয়া ধানমন্ডির প্লটে বাড়ি নির্মাণে রাজি করান স্বামীকে। কিন্তু অধিকাংশ সময় জেলে কাটানো স্বামীর হাতে বাড়ি বানানোর টাকা কোথায়?
বেগম মুজিব ছিলেন দৃঢ়চেতা বাঙালি নারী। তিনি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। নিজের কাছে ছিল সঞ্চয় করা কিছু টাকা। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করলেন দীর্ঘমেয়াদে। তার সঙ্গে যুক্ত হলো বঙ্গবন্ধুর বেতনের সামান্য আয়। বঙ্গবন্ধু তখন আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
১৯৬০-৬১ সালের দিকে বাড়ি নির্মাণ শুরুর এক পর্যায়ে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে কিছু টাকা ঋণ নেওয়া হয়। বাড়ি বানানোর সময় কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী মুজিব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম, তৎকালীন পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকোশলী পরে পূর্তসচিব মাইনুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম ‘ওরফে পোস্টার নুরু’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মাইনুল ইসলাম বিনা পারিশ্রমিকে বাড়ির নকশা করে দিয়েছিলেন। নির্মাণ কাজেরও তদারকি করেছেন তিনি। কখনও নির্মাণসামগ্রী বা অন্যান্য জিনিস সরবরাহে এগিয়ে এসেছেন জহুরুল ইসলাম।
নির্মাণাধীন বাড়ির সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন পোস্টার নুরু। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এমন বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক এদেশে বিরল। বাড়ি নির্মাণের সময় পোস্টার নুরু যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলে বঙ্গবন্ধু তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে দেখতে বঙ্গবন্ধু সপ্তাহে একদিন হাসপাতালে যেতেন। এভাবে তিন মাসের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে নুরুল ইসলাম প্রায়শ ক্রসওয়ার্ড লটারি খেলতেন। লটারিতে নামঠিকানা দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় তিনি একদিন সেখানে শেখ রেহানার নাম দেন। সেদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। তখনকার সময় সেটা ছিল বিশার অঙ্ক। সে টাকা নিয়ে তিনি সোজা চলে যান বেগম মুজিবের কাছে। ঘটনা খুলে বলে তিনি জানান, ‘টাকাটা তো আমি রেহানার ভাগ্যে পেয়েছি। তাই ভাবি এটা আপনার কাছে রেখে দেন। মুজিব ভাইয়ের বাড়ি নির্মাণে অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় হচ্ছে বরং এ কাজে তা খরচ করবেন।’
তার এমন দরদভরা কথায় বেগম মুজিব টাকাটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের কাছে রেখে দেন। বলা বাহুল্য তিনি টাকাটা বাড়ি নির্মাণে খরচ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সেটা নুরুল ইসলামকে অনেকটা জোরপূর্বক ফেরত দিয়েছিলেন।
৩২ নম্বরের বাড়ি নির্মাণে বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক কর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। সেসব তথ্য হয়তো গবেষক লেখকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান রাজনীতির পাশাপাশি লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা করতেন। তেজগাঁয়ে তার একটি গ্রিল তৈরির কারখানা ছিল। তিনি প্রিয় নেতার ৩২ নম্বরে বাড়ি নির্মাণের সময় জানালার গ্রিল সরবরাহ করেছিলেন। বাড়ির মধ্যে রোপনের জন্য নারিকেল ও সুপারি গাছ গ্রাম থেকে এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি শেখ মোহাম্মদ মুসা। বাড়ির সামনে ঝাউ গাছ লাগিয়েছিলেন নূরউদ্দিন আহমেদ।

দুইটি বেড রুম, একটি ড্রইং রুম এবং একটি গেস্টরুম দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ৩২ নম্বরের জীবন শুরু করেছিলেন। বেডরুমের একটিতে সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু থাকতেন। একটিতে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। গেস্টরুম শেখ কামাল ও শেখ জামাল ব্যবহার করতেন। ড্রয়িং রুমে সাজানো হয়েছিল কমদামি একটি বেতের সোফাসেট দিয়ে।
এ বাড়ির সঙ্গে বেগম মুজিব ও শেখ মুজিবের অনেক পরিশ্রম, ত্যাগ আর ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি গণভবন ও বঙ্গভবনের জৌলুস আর রাষ্ট্রীয় চাকচিক্য, সুযোগ সুবিধা বাদ দিয়ে কার্পেটবিহীন, শীততাপ নিয়ন্ত্রণহীন সাধারণ একটি বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন। ষাটের দশকের ছায়াসুনিবিড় ধানমন্ডিতে খরগোশ আর সজারু ঘুরে বেড়ানো পরিবেশ তাদের মনকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করত।
আপেল মাহমুদ
নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১ ডিসেম্বর, ২০২০ লিঙ্ক