বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, সাহসিকতা, অবিচলতা ও বিশালতায় মুগ্ধ হয়ে কিউবার বিপস্নবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো একসময় বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করেও তাঁকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো আমারও বিশ্বাস- ‘যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরী যমুনা বহমান/ তত দিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার প্রথম মুগ্ধতা ছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। তার ভাষায় পলিমাটির সৌরভ, তার কণ্ঠে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কলেস্নাল, মেঘের মতোই মায়া আর বজ্র। তার তর্জনীতে বাংলার মানুষের গন্তব্যের নির্দেশনা। তার সম্মোহনী কণ্ঠের জাদুকরী এই ভাষণটা আমি এতবার শুনি, কখনো পুরনো মনে হয় না। মন চায় আরও শুনি, বারবার শুনি। যখনই শুনি, গায়ে কাঁটা দেয়। শরীরে জাগে অভূতপূর্ব উন্মাদনা। আমার দেহ এক অনির্বচনীয় পুলক শিহরণে শিহরিত হয় এবং পরম শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে আমার হৃদয় মন। তার প্রতি আমার মুগ্ধতার উন্মেষ নিতান্ত শৈশবে। আমি তখন প্রাথমিকে পড়ি। আমার শৈশবের পলিস্ন গ্রামের ক্ষুদে পাঠশালাটিতে প্রতি বছর বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। বাড়িতে মা-বাবার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মুখস্থ শিখে ও ক্রমাগত অনুশীলন করার পরে পাঠশালার অনুষ্ঠানে তা মঞ্চস্থ করতাম। ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ পর্বে ক্ষুদে বঙ্গবন্ধু সেজে প্রতিবারই প্রথম স্থান অধিকার করতাম। উপস্থিত দর্শকদের করতালি ও পুরস্কারপ্রাপ্তিতে যতটা না আনন্দিত হতাম, তারচেয়ে বেশি অভিভূত হতাম তখন, যখন আমি বঙ্গবন্ধুর মতো তর্জনী উঁচিয়ে বলতাম ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। আমার শিশুমন এই ভাষণের মাহাত্ম্য ও বঙ্গবন্ধুর বড়ত্ব খানিকটা হলেও ঠাওর করতে পেরেছিল। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, অবিচলতা ও বিশালতা অনুভব করার জন্য আমাদের তরুণদের নিকট ৭ মার্চের এই একটি ভাষণ তার জীবনকাহিনির শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য চর্যাপদ নয়, বৈষ্ণব গীতিকা নয়, সোনার তরী কিংবা গীতাঞ্জলি কোনোটা নয়, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগীতি হলো ‘আর দাবায়া রাখতে পারবা না’। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন, ‘অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
Leave a Comment