একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশ। আর এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে নতুনভাবে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়- বাংলাদেশের উন্নয়নের বিভিন্ন সম্ভাবনা কীভাবে খুঁজে বের করা যায় এবং কীভাবে তার টেকসই বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেসব বিষয়ে তিনি শুধু দেশের নয়, দেশের বাইরেও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কর্মপরিকল্পনা ও মতামত গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলেন বাংলার মাটি, মানুষ, পরিবেশ, প্রকৃতিকে। নিজস্ব উপলব্ধি থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।
বিভিন্ন গবেষণা এবং তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনার বিস্তৃতি রয়েছে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার বিভিন্ন স্তরে যার আরও অধিক পরিমাণে সম্প্রসারণ প্রয়োজন। ক্ষুধা আর দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গঠনে জাতিসংঘ ২০১২ সালকে সমবায় বর্ষ হিসেবে ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু গ্রামবাংলার মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুঃখ, শোষণ-নিপীড়ন দূর করে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম-সমবায় কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে সবুজ বাংলাদেশ গঠনকল্পে বঙ্গবন্ধুর অনেক পরিকল্পনা তার বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সর্বত্রই ছিল ধ্বংসলীলা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, কৃষির উৎপাদন এমনকি পুনর্বাসনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তিনি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেন এবং দেশের সার্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করেন। কলকারখানার উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো সম্ভব, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কেমন রূপ ধারণ করবে এসব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তা এবং বিশ্নেষণ তার কর্মধারার মধ্যে বিশদভাবে ছিল। তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। যার লক্ষ্য ছিল মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নয়ন, পণ্যের চাহিদা, কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত কাঠামোতে সমসাময়িক রূপান্তর ইত্যাদি। এমনকি তার ভাবনার মধ্যে ছিল দেশের খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং কৃষিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। বঙ্গবন্ধু জাপান সফরকালে সে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তানাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে যমুনা বহুমুখী সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) নির্মাণের স্বপ্নের কথা প্রথম সূচনা করেন, যা শুধু যাতায়াতের জন্য নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জুন মাসের এক ভাষণে বলেছিলেন, দেশের প্রতিটি মানুষ খেতে পাবে, আশ্রয় পাবে। বলেছিলেন, প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। আর এটি ছিল তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য। তার বিভিন্ন ভাষণে উঠে আসে গ্রামের পরিবেশ, কৃষি, প্রকৃতি, আর সেইসঙ্গে কৃষকের কথা। নিজস্ব সংস্কৃতির স্থাপত্য ও পরিকল্পনাকে বুঝতে হলে প্রয়োজন এই সবকিছুর সমন্বয়। তিনি সর্বস্তরে বৃক্ষরোপণের ডাক দিয়েছিলেন, উপকূলীয় বনায়ন করেছিলেন, বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন প্রণয়ন করেছিলেন, জলাভূমি রক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করে বহুমুখী কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিলেন, যা ছিল সুস্থ এবং পরিবেশবান্ধব সমাজব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার বিভিন্ন লেখনীতে টেকসই নগর এবং গ্রাম উন্নয়নের ভাবনা, পরিবেশ-প্রকৃতিগত ভাবনার বিভিন্ন রূপরেখা ব্যক্ত করেছেন। গ্রাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই তার ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন, সুষ্ঠু বিদ্যুতায়ন ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, মাতৃসদন, কৃষি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খেলার মাঠ, প্রশস্ত রাস্তাঘাট, মজবুত ঘরবাড়ি প্রভৃতির কথা। সেইসঙ্গে বলেছেন নদনদী, খাল-বিলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে খামার তৈরি, সর্বোপরি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কুটির শিল্পের মানোন্নয়ন এবং শিল্পের বিকাশ। তার শৈশবের সমস্ত স্মৃতিজুড়েই রয়েছে গ্রামের সহজ-সরল প্রকৃতি আর পরিবেশ। তিনি বলেছেন, ‘গ্রামের ছায়ায় ঘেরা, মায়ায় ভরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং সরল সাধারণ জীবনের মাধুর্যের মধ্য দিয়ে আমি বড় হয়ে উঠি।’ বর্তমানেও তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যে-চিন্তায় শহরের টেকসই উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা প্রদত্ত গ্রাম এবং নগর উন্নয়নের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা সুষ্ঠুভাবে সন্নিবেশ করা প্রয়োজন। কারণ আমরা সব সময়ই তাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোকপাত করি। কিন্তু এর সঙ্গে তাদের নগরায়ণ, শিল্পায়ন, গ্রামোন্নয়ন, স্থাপত্য, পরিবেশ ভাবনা নিয়ে তাদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশকে আরও নিবিড়ভাবে বিচার-বিশ্নেষণের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া প্রয়োজন। আর এভাবেই যদি আমরা গবেষণার মাধ্যমে সমন্বিত গ্রাম এবং শহরের বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করতে পারি এবং সেভাবে স্থাপত্য চর্চা এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশকে আরও টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে সেটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য আরও বেশি ফলপ্রসূ হবে।
কী তাদের নগরায়ণ-গ্রামোন্নয়নের ভাবনা? কী স্থাপত্য এবং পরিবেশ ভাবনা? এ সম্পর্কে আরও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই। এ জন্য প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র জাতীয় ‘বঙ্গবন্ধু গ্রাম ও নগর উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র’ কিংবা প্রতিষ্ঠান, যেখানে শুধু বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। যাকে তিনি বলতেন ‘সোনার বাংলা’। আশা করছি এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অচিরেই।
সজল চৌধুরী শিক্ষক ও স্থপতি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত
sajal_c@yahoo.com