জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনে সরকারের প্রস্তুতি জনসাধারণের নজর কাড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণ গণনা শেষ হতে আর বেশিদিন বাকি নাই! আর কিছুদিনের মধ্যে আমাদের অপেক্ষার অবসান হবে, শুরু হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর উদযাপন। কিন্তু, বাংলাদেশের মানচিত্রে বঙ্গবন্ধুর যে প্রতিকৃতি আমরা আঁকতে চেয়েছিলাম, জাতি হিসাবে আমরা তা করতে কতটা সমর্থ হয়েছি? এরকম একটা প্রশ্ন তোলার অধিকার নিশ্চয়ই আমাদের আছে, কারণ আমার ভয় হয়, জন্মশতবার্ষিকীর বর্ণাঢ্য আলোক উৎসবের ভিড়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেই না আমরা হারিয়ে ফেলি! আমি জানি আপনারা আমার মত দুর্বল চিত্তের মানুষ নন, এবং আমার ভাবনা অমুলক হলেই বরং তা হবে আনন্দের।
আমরা যে দিকেই তাকাই না কেন সর্বত্র বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের একটা প্রচেষ্টা চোখে পড়বে। কিছু প্রচেষ্টা ভালো এবং ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপস্থাপনের ধরণ, রীতি নীতি, কৌশল দেখে আপনার মনে সংশয় জাগতে পারে, সেখানে কতটা বঙ্গবন্ধু আর কতটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদেরকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন! দৃশ্যগ্রাহ্য ও হৃদয়গ্রাহ্য শব্দ দুটির মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেটা আমরা বিবেচনায় আনতে পারছি কতটা? বঙ্গবন্ধুকে দার্শনিক কিংবা নান্দনিকভাবে উপস্থাপনের উদ্যোগ সুদূর-পরাহত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে কেটে চেটে নিজের উপযোগী একটা ফরমেটে ফেলতেই আমরা বেশি উৎসাহী। এর একটা কারণ হতে পারে বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ অবয়বের মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর তর্জনী আমাদের তাড়া করে ফিরছে, আর আমরা ঢাল হিসেবে বুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়ে ঘুরছি। এরকম অবস্থায় আমরা একদিনে আসি নাই, এর পেছনে রয়েছে আমাদের দীর্ঘ মানসিক দৈন্যতা ও সামাজিক -অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার হীন মনবাসনা। আবার অন্যদিকে একটা কুচক্রী মহল কাজ করছে কিভাবে ভালো উদ্যোগের ভিতরে বিষ ঢেলে দিলে একটা পর্যায়ে সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়বে! আশার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে সকল পক্ষকে এই বিষয়ে সচেতন হবার আহ্বান জানিয়েছেন।
শিক্ষা প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগ বোধ করি সবার জানা, সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। ডঃ মমতাজ পাটোয়ারী সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘আপনারা বুদ্ধিটা জনগণের খেদমতে ব্যয় করুন’; অভিযোগ আছে বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের খেদমতে বেশি মনোযোগী হয়েছেন। এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বঙ্গবন্ধুকে সঠিক ও হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপনে জাতি হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, এই ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে আরো শানিত করা প্রয়োজন। এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর ২৬টি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে যা নিঃসন্দেহে একটা ভালো উদ্যোগ। জাতির মনন বিনির্মাণে এ ধরণের উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখে। এর বিপরীত উদহারণও রয়েছে, যদিও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আলোচনার স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ টানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার কর্মচারিদের জন্য সদ্য নির্মিত একটি বহুতল আবাসিক ভবন এর নাম রেখেছেন ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ ! তারমানে কি আমরা ধরে নিব এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে সেরা অর্জন যা তারা বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করেছেন। ধরুন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসলো, তখন তাদের দেখানো হবে লর্ড কার্জন হলে বিজ্ঞান চর্চা হয়, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অ্যাসেম্বলি হয়, আর বঙ্গবন্ধু টাওয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা তাদের পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এর আরো ভালো ব্যাখ্যা থাকতে পারে, আমরা দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক সম্পদ শিক্ষা ও গবেষণার সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম অঙ্কিত হয়নি! তার মানে কোথায় বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার হবে আর কোথায় হবে না, সেটা আমরা গভীর বিবেচনায় আনতে পারি নাই।
দেশে কিংবা দেশের বাহিরে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের আরো বেশি যত্নবান হবার সুযোগ আছে। আমরা চাইবো আমাদের সর্বোচ্চ সেরাটুকু দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করতে, যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও একটা দিক নির্দেশনা পায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের নেতাদের কিভাবে বিশ্বসভায় তুলে ধরছেন, সেসব কর্মকাণ্ড থেকে আমারা কি শিক্ষতে পারি সে কথা আমাদের ভাবতে হবে। জন এফ কেনেডি সেন্টার বা ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারগুলো বাংলাদেশের তরুণদের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করছে, এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণরা যেমন আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে, পাশাপাশি সেদেশের নেতাদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করছে এবং উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে আমরা কবে ‘বঙ্গবন্ধু সেন্টার’ স্থাপনের মত উদ্যোগ নিতে পারবো? আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের মিশনগুলো নিশ্চয়ই কাজ করছেন।
ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকভাবে বাংলার মাটিতে দুর্নীতিপরায়ণতা, অন্যের সম্পদ দখল, কালোবাজারী, মজুদদারদের সিন্ডিকেট, ধর্মব্যবসা ইত্যাদি শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। আর আমরা সেই লড়াইটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, আর সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতি হিসেবে আমরা তখনই বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখতে পারবো যখন আমরা মুজিববাদী হতে পারবো। বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে মুজিববাদী হওয়াটা যে সহজ কাজ হবেনা, তা আমরা জানি। প্রসঙ্গত, দিল্লির সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে টেনে আনা যেতে পারে। কংগ্রেস যা করতে পারে নাই, সেটা করে দেখিয়েছেন গান্ধীবাদী নেতা আম আদমি পার্টির কর্ণধার অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশীদার করেছেন এবং তাদের দুর্দশা লাঘবে নজর দিয়েছেন। কেজরিওয়াল এর বিজয় ভারতবাসীকে যেমন একটা বার্তা দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটা বার্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর সেখানেই আমাদের মুজিববাদী হয়ে উঠবার যথার্থতা নিহিত আছে।
প্রত্যেক পিতা যেমন তার সন্তানের কাছে সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয়, তেমনি বাঙালি জাতি হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের শেষ আশ্রয়। সুতারং তাকে আমরা যেভাবে উপস্থাপন করবো, প্রজন্ম সেভাবেই গ্রহণ করতে শিখবে। আমরা যদি মুজিবের ছায়া অনুসরণ করতে না শিখি, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের একদিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। মুজিব শতবর্ষে সত্যিকারের মুজিব চর্চা আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। একজন মুজিব কেবলমাত্র বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান নয়, একজন মুজিবের প্রয়োজন কখনো শেষ হবার নয়। আমরা চাই বাংলাদেশে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুর উপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়া এসে পড়ুক, ছায়া পড়ুক বাংলাদেশের বুকে।
Link: Channel I Online |
Leave a Comment