১.
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট গোপালগঞ্জে চলছিল ফুটবল খেলা। ছোট শহরে এ ধরনের আয়োজনে যে রকম উত্তেজনা থাকে, তা যারা দেখেছেন তারা সবাই অনুধাবন করতে পারবেন। মাঠে ২২ জন খেলোয়াড় যে পরিমাণ ঘাম ঝরিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন, মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দর্শকরা তাদের চিৎকার-প্রতিক্রিয়া আর উত্তেজনায় তার চেয়ে কম ঘাম ঝরান না। এই ক্রীড়ামুখর একটা শহর পরদিনই ভয়ার্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক স্তব্ধতা ও আতঙ্কের শহরে নিমজ্জিত হবে। যার রেশ বহু দিন পর্যন্ত বহন করতে হবে।
গোপালগঞ্জ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নিজের শহর, তাই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সেখানকার জনগণের ওপর অন্যরকম চাপ ও আতঙ্ক তৈরি করেছিল। এই বিশেষ দিনটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে গোপালগঞ্জবাসীর ওপর ১৫ আগস্টের ট্রমা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা হতে পারে। জেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক দিনের ব্যবধানে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ, সরকারি চাকরিজীবীসহ অনেকের রোষের শিকার হতে হয়েছিল কাউকে কাউকে। মূলত আত্মগোপনেই চলে যেতে হয় সবাইকে।
ওই দিনটির আগে ও পরে জেলা আওয়ামী লীগের অবস্থা নিয়ে আমরা অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরেই কাজ সারতে হয়েছে। ওই সময়ে যারা সক্রিয় ছিলেন, তাদের বয়স এবং অনেকের শারীরিক অবস্থার কারণে দেখা করা সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুকে তাদের শৈশব থেকে দেখেছেন এবং তার সান্নিধ্যে রাজনীতি করার সৌভাগ্য হয়েছে এ রকম দুজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে ও পরের ঘটনা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। তারা হলেন গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী এমদাদুল হক ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু। ২.
শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু জানান, ১৯৭৫ সালে, আমি তখন গোপালগঞ্জ ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ১৪ আগস্ট গোপালগঞ্জ একাদশ আর মাগুরা একাদশের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ছিল। দুই দলের থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে, মাঠের খেলাটা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, মানুষ যেন তা উপভোগ করতে পারে, সমস্ত দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। খেলা হয়েছিল চমৎকার। স্টেডিয়ামের কানায় কানায় দর্শকভর্তি। সবাই খুব উপভোগ করেছিল খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য। খেলা শেষে মাগুরা টিমকে আমরা যখন বিদায় দিলাম, রাত তখন প্রায় ১২টা। সে সময় গোপালগঞ্জ থেকে মাগুরা যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল বেশ জটিল। এখান থেকে নৌকায় করে হরিদাসপুর, সেখান থেকে লঞ্চে টেকেরহাট, সেখান থেকে আবার বাসে করে যেতে হবে ফরিদপুর। ফরিদপুর থেকে আবার আরেক বাস ধরে মাগুরা যেতে হয়। তাদের বিদায় দিয়ে গোপালগঞ্জ দলের খেলোয়াড়, দলের কিছু নেতাকর্মী এবং প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা আমরা সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া যখন শেষ করলাম, রাত তখন প্রায় ২টা।
তখন তো বয়স কম, এরপর প্রায় ভোররাত ৪টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আমি বাসায় ফিরে ঘুমাতে গেলাম ফজরের আজানের সময়। আর আমার পাশের ঘরেই কয়েকজন খেলোয়াড়ের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নায়েব আলী নামে এক খেলোয়াড় ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন। তিনি এসে আমাকে ডেকে তুললেন, ভাই ওঠেন রেডিওটা একটু শোনেন। আমি ঘুমের ঘোরে জানতে চাইলাম, বলেন কী হয়েছে, তিনি জবাব না দিয়ে আমাকে হাত ধরে টেনে রেডিওর কাছে নিয়ে গেলেন। রেডিওতে তখন মেজর ডালিমের কণ্ঠ ভেসে এলো। বলল, ‘‘বঙ্গবন্ধু একজন বিট্রেয়ার, জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছেন, বিশ্বাসঘাতককে আমি হত্যা করেছি।’’ বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপরও বারবার রেডিওতে ওই একই কণ্ঠ, একই ঘোষণা দিতে থাকল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি প্রায় কাণ্ডজ্ঞানহীন, বুদ্ধিহারা হয়ে গেলাম। বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম, দেখলাম গোপালগঞ্জের রাস্তাঘাটে কোথাও কোনো মানুষ নেই। একজন মানুষও দেখিনি আমি। শুধু কয়েকজন পুলিশকে দেখা গেল। সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টার দিকে আমাদের ক্রীড়া সংস্থার কিছু কর্মকর্তা, মরহুম মন্টু ভাই, তিনি নিজেও অত্যন্ত ভালো খেলোয়াড় ছিলেন, মোহাম্মদ আলী, খায়ের, মুকুল আমার কাছে এসে বললেন, আপনি তো গোপালগঞ্জে আর থাকতে পারবেন না। আর যদি চলে যান, তাহলে এই লোকগুলোর তো কিছু দেনা-পাওনা আছে। তখন আমি বললাম, যারা আমাদের কাছে টাকা পান, তারা যেন স্টেডিয়ামে আসেন। যেমন যারা খাবার সরবরাহ করেছেন, স্টেডিয়ামে চেয়ার সরবরাহ করেছেন, বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন। তাদের ডেকে ডেকে পাওনা মিটিয়ে দিলাম। এরপর আমি তখনকার এসডিও অফিসে গেলাম, এখন যেটা ডিসি অফিসে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন কাদের সাহেব, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট, তার চেম্বারে। তিনি নিজেই মর্মাহত, কী বলবেন আর কিইবা শুনবেন বুঝতে পারছিলেন না।
আসলে গোপালগঞ্জের সবারই এই অবস্থাই হয়েছিল, একজন লোককেও আমি সেদিন স্বাভাবিক দেখিনি। আকাশটাও সেদিন অন্ধকার হয়েছিল, যেন কাঁদছে। বাতাসে গুমোট ভাব। কেউ কোনো কথাই বলতে পারছিল না। দোকানপাট কিছুই খোলেনি। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ থানার এক পুলিশ অফিসার আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বসল। কোনো কারণ ছাড়াই। তখন বুঝলাম, যারা ভাই বলে ডাকত আজকে তারা চোখ উলটে দিয়েছে। এদের কারও সঙ্গে কথা না বলে, আমি তখন আত্মগোপনে চলে গেলাম। নদীর ওপারে আমার এক বন্ধু, মরহুম আবুল খায়ের, তাদের বাড়িতে চলে গেলাম। তিন-চার দিন পর আবার গোপালগঞ্জে ফিরলাম। তখন যিনি এসডিও ছিলেন, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাকে অভয় দিলেন। বললেন, আমি যত দিন দায়িত্বে আছি তত দিন আপনাদের কারও অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। তখন সামরিক শাসন জারি হয়ে গেছে। আরেকজন ভদ্রলোক ছিলেন ইন্সপেক্টর আবদুর রহমান, অত্যন্ত চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বললেন, যারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী, যাদের রাজনৈতিক জীবনে কোনো কালো দাগ নেই, তাদের নিরাপত্তা তিনি দেখবেন। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকেই ক্ষমতার দম্ভে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। যারা সে রকম নন, তাদের আমরা দেখব। আমি তখন বললাম, পুলিশ যদি আমাদের পেছনে ধাওয়া করে, তাহলে আমরা আর এই দেশে থাকতে পারব না। বরং আমরা ভারতে চলে যাই, সেখানে কিছু একটা করে খেতে পারব। তিনি বললেন, কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী সময়ে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি।
এরপর প্রায় এক-দুই বছর সময় পর্যন্ত গোপালগঞ্জে উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। যেটুকু শুরু হয়েছে, তা খুবই ঘরোয়া পরিবেশে, নিজেদের মধ্যে, যাদের সঙ্গে মনের মিল আছে কিংবা বিশ্বাস করা যায় এ রকম কয়েকজন, যেমন ছাত্র ইউনিয়নের কিছু সদস্য আর অন্যরা একসঙ্গে হয়ে কিছু করার চেষ্টা হয়েছে। প্রায় এক বছর পর, দলের শীর্ষস্থানীয়দের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে, ১৯৭৬ সালে প্রথম আমরা কোনো মিছিল করতে পেরেছিলাম। তারপরই পুলিশ মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করে। সেই মিছিল হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, শওকত চৌধুরীর নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, আর্মিরা গোপালগঞ্জ থেকে শওকত চৌধুরী, সিজি মোস্তফা, ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট, কামরুল ইসলামসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কিছু লিফলেট, পোস্টার এসব আসত ভারত থেকে, সেটা আনত মজিবর নামের একজন (এখন প্রয়াত), টুঙ্গিপাড়ার আওলাদ এবং জিল্লুর এ রকম কয়েকজন। খুলনার তেরখাদায় ফুল ভাই নামের একজন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন, তিনিও নিয়ে আসতেন। সেগুলো আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিলি করতাম। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা সে সময় ভারতে গিয়ে সে দেশের সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার বিষয়ে। কিন্তু ভারত সরকার তাদের আশ্রয় দেবে বা সহযোগিতা করবে, সে রকম কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি। সে কারণে তারা তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। একটা সময় তো ইন্দিরা গান্ধীর পরে যে সরকার আসে তারা জানিয়েই দিল যে এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তারা কোনো আশ্রয় দেবে না। সে সময় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো কর্মকাণ্ডকে নাশকতামূলক কাজ বলা হতো। তখন অনেক নেতাই ভারত থেকে ফিরে এসেছেন। অনেককে পুশব্যাক করা হয়েছে। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ কর্মী, অনেকে না। পরে তাদের অনেকেই আবার বিএনপিতে চলে গেছেন। এর অর্থ হলোÑ মূল নেতৃত্ব যদি সঠিক নির্দেশনা দিতে না পারে, তাহলে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন আন্দোলন বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।
শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু জানান, ব্যক্তিগতভাবে আমার বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার প্রথম সুযোগ হয়, তিনি যখন আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হয়ে আসেন তখন। এর আগে তো ছয় দফা দাবি দিয়ে তিনি কারাগারে। সারা বাংলাদেশে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মামলার খরচের জন্য চাঁদা তুলেছেন। আমিও সঙ্গে থাকতাম। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ডেই আমি অংশ নিয়েছি। তো মামলা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি গোপালগঞ্জে এলেন। আমরা তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বলে ছাত্রলীগের কার্যালয় তাকে দিয়ে উদ্বোধনের ব্যবস্থা করলাম এবং আমাদের এক-দেড় ঘণ্টা সময় দেবেন, যাতে করে অন্তত আমাদের সব নেতাকর্মীর মাথায় তিনি একটু হাত রাখতে পারেন। সে সময়ই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একটু স্পর্শ পাওয়া মানে বিশাল ব্যাপার। এটা জীবনের একটা বড় পাওনা, যার মাথায় তিনি একবার হাত রেখেছেন। শুধু ছাত্রলীগের কর্মীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য দুই ঘণ্টা সময় বরাদ্দ দেওয়া হলো, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীও সেখানে ঢুকবে না। তখন আমাদের কার্যালয় ছিল সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম জামাল চৌধুরী, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাই কামালও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের ব্যাংকপাড়ার বাসায় ছাত্রলীগের অফিস ছিল। বঙ্গবন্ধু সেখানে এলেন, সবাইকে ডেকে ডেকে কাছে বসিয়ে কথা বললেন। সবার আগে যার সঙ্গে কথা বললেন, তিনি আমার বন্ধু মরহুম মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেন খসরু, তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমার সঙ্গেও পরিচয় হলো, আমার সৌভাগ্য, তিনি কয়েকবার আমার নাম ধরে কথা বলেছিলেন সেদিন। সেখান থেকে আমরা মিছিল করে আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিলাম। পরে তিনি বলেন, তোদের অফিস তো দেখলাম চেয়ার-টেবিল-আলমারির অভাব। এগুলো কেনার জন্য নিজের পকেট থেকে বের করে ২০০ টাকা তিনি আমাদের দেন। এই ২০০ টাকা আমাদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার ছিল।
৩.
পরে আমরা কথা বলতে যাই চৌধুরী এমদাদুল হকের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় এবং রাজনীতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আমি যখন প্রাইমারিতেও পড়ি না, আমি তখন একটা পাঠশালায় পড়ি। সে সময় বঙ্গবন্ধু শুধু কলকাতা থেকে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’তে ভর্তি হয়েছেন। তখন তিনি মাঝেমধ্যেই গোপালগঞ্জ আসতেন। তিনি কে, তা তো তখন আমার জানার কথা না। নাসের (আবু নাসের, বঙ্গুবন্ধুর ছোট ভাই, ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে নিহত) ভাই থাকতেন যে ঘরে, টিনের একটা লম্বা ঘর, ইউ প্যাটার্নের। গোপালগঞ্জে তখন কোনো বিল্ডিং ছিল না, সিনেমা হলটাও টিনের ঘরে। তো নাসের ভাইয়ের কাছে আসতেন তিনি। আমরা থাকতাম তার পাশে। বাসার সামনে একটা কাঠের সিঁড়ি ছিল। সেখানে আমি আর আমার বড় বোন, সে তখন বীণাপাণিতে পড়ত ক্লাস সিক্সে আর আমি তো পাঠশালায়, স্কুলে যাওয়া শুরু করি নাই তখনো, পরেশ বাবুর পাঠশালায় পড়ি। তখনই প্রথম তাকে দেখি।
তারপর পরিচয় হলো ৫৪-এর নির্বাচনে। তিনি প্রার্থী। তার বিরুদ্ধে ক্যান্ডিডেট তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু তো তখন মাত্র শুরু করেছেন, নেতা হিসেবে পরিচিতিটা আসছে মাত্র। সে সময়, আমার বাড়ি তো মানিকদাহ, এখন যে চেহারা আর তখনকার মানিকদাহর চেহারা এক না। ওই সময় যারা আসছে সেখানে, তারা তো এখন আর চিনবে না মানিকদাহ। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে একটা খাল ছিল। আমাদের গ্রামে ঢুকতে হলে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে নৌকায় নামতে হতো। যাতায়াত ছিল একমাত্র টাবুরে নৌকা দিয়ে।
আমার জন্ম তো ব্রিটিশ আমলে, ৫৪-তে আমি তখন সিক্সে পড়ি। তো নির্বাচনের প্রচারে গ্রামে এসে বঙ্গবন্ধু তখন আমাদের বাড়িতে উঠলেন। আমাদের বাড়িটা, এখানে বাদশাহ ভাই, তিনি বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বাড়িতে এনে ওঠালেন, চা-নাশতার ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল। ঠিক উনি যখন বাড়িতে ঢুকবেন এর মধ্যেই ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবও এসে উপস্থিত। আমার সম্পর্কের এক চাচা সে ওয়াহিদুজ্জামানের দলের লোক, মুসলিম লীগের, তিনি তাকে নিয়ে আসছেন। তো আমাদের বাড়িতে একটা বড় বৈঠকখানা ছিল, যেটাকে বলা হতো কাছারি ঘর। তো সেখানে দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে এসে একসঙ্গে চা-নাশতা করলেন। তো চা-নাশতা খাওয়া শেষে ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ভাইজান আপনি যাবেন কোথায়। ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব বললেন, তিনি পশ্চিমপাড়ার দিকে যাবেন। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে আপনি ওদিকে যান আর আমি তাহলে উত্তরপাড়ার দিকে যাব। এরপর নির্বাচনের সময় আরও একবার আসছিলেন বঙ্গবন্ধু, তখনো দেখা হয়েছে।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে ও পরের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সময় তো বাকশাল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তো তখন ঢাকার সার্কিট হাউজ এলাকায় বাকশালের সেন্ট্রাল অফিস করা হয়েছে। আমাকে ডেকে পাঠালেন আবদুল্লাহ মিয়া, বাকশাল অফিসে গিয়ে দেখা করলাম মণি ভাইয়ের সঙ্গে। মণি ভাই আমাকে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। তোফায়েল আমাকে কয়েকজনের নাম সাজেস্ট করতে বলল, আমি বললাম সেটা তো আমি পারি না, সেন্ট্রাল যা করবে আমরা তো সেটা মেনে নেব। তখন তোফায়েল কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে খোঁজখবর জানতে চাইল। তাদের মধ্যে ছিলÑ নওফেল আহমেদ বাচ্চু, লুৎফর রহমান বাচ্চু, রহমান, ন্যাপের নুরুজ্জামান খোকন, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে শওকত চৌধুরী আর আবু হোসেন। তো বাকশালের স্ট্রাকচারটা তো ছয়জনের, আমার কাছে এই ছয়জনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল তোফায়েল, তো আমি তো বুঝে গেলাম। হয়তো আমি সেক্রেটারি। তো আমি মণি ভাইকে বলে বাড়ি চলে আসব আর আসার আগে মোল্লা জালাল সাহেবের বাসায় যাব একবার। তো গেলাম ১৩ আগস্ট জালাল সাহেবের বাসায়, চাচি-আম্মার সঙ্গে কথা বললাম। জালাল সাহেব তিন দিন আগে ইসলামিক দেশগুলোর একটা সম্মেলন শেষে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরছেন। পরে শুনেছি ১৪ তারিখ জালাল সাহেব গণভবনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু মোল্লা জালালকে দেখে ৩২ নম্বর ফোন দিয়ে বেগম মুজিবকে সেই সংবাদ দিয়ে বললেনÑ আমরা একসঙ্গে খাব। ওখানে আর কথাবার্তা না বলে বাসায় চলে এলেন মোল্লা জালালকে নিয়ে। তো সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ির নিচতলায় দুজন কথা বলতে ছিলেন। এ সময় রাজ্জাক ভাই ঢুকে বঙ্গবন্ধুর কানে কানে কী যেন বললেন। এটা দেখে জালাল সাহেবের মন খারাপ হয়। ফলে মোল্লা জালাল সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ খাওয়া আর সেটা ছিল তার বাল্যবন্ধু মোল্লা জালালের সঙ্গে।
তো যাক সে কথা।
আমি তো ১৪ তারিখ ভোরে চলে এলাম গোপালগঞ্জ। বাড়ি এসে ঘুমিয়ে আছি। তখন তো এক দিন সময় লাগত আসতে, ১৩ তারিখ মোল্লা জালালের সঙ্গে দেখা করে রওনা দিয়েছি, পরদিন ভোরে বাড়ি পৌঁছেছি। তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, সেই ভোরবেলা লাবলু উকিল বাসায় এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললÑ মামা রেডিও শোনেন। আমি বললাম কেন, কী হয়েছে, ও বলল, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। শুনেই আমি ওকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসছি। কিন্তু পরে রেডিও শুনলাম, তারপর তো জানলাম ঘটনা সত্য। আমি সঙ্গে সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরে চলে এলাম। একদম সব স্তব্ধ হয়ে গেছে দেখলাম। প্রতিবাদ করবে কে, কেউ নেই শহরে।
শুনলে তোমরা আশ্চর্য হয়ে যাবা, তা ডেডবডি নিয়ে এই গোপালগঞ্জের ওপর দিয়ে যখন যায়, তখন এখানে একজন এডুকেশন অফিসার ছিলেন, আমি নিজের কানে শুনছি, মসজিদের সামনে সে বলতেছেন, ওরে আবার হেলিকপ্টারে নিয়ে যাচ্ছে, পোড়ায় দিল না কেন! তার ছেলে শেখ হাসিনার আশীর্বাদে বড় একজন সচিব। তো এই হলো একজন শিক্ষা অফিসারের মন্তব্য। তবে জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চার দিনের দিন মিলাদ দিয়েছিলাম থানাপাড়ার মসজিদে। কয়েক দিন পর আমরা বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে গেলাম। এসব করতেও তখন লোক ভয় পেত।
আমরা কিছুদিনের মধ্যে মিছিল করেছি। কিন্তু তখন আমরা আরও বড় মিছিল-প্রতিবাদ করতে পারতাম কিন্তু করিনি, সেটা ভুল করেছি। ভয়ও ছিল। সে সময় ছাত্র ইউনিয়ন ভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছে। আমরাও করেছি, তবে আলাদাভাবে। এ কারণে অনেকে অ্যারেস্ট হয়েছে। শওকত চৌধুরী একটা চিঠিসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল, ওই চিঠিতে আমারও নাম ছিল।
মোহাম্মাদ সাঈদ জুবেরী চিশতী ১৫ আগস্ট ২০২০ লিংক