আরেক প্রয়াত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ‘শান্তির দূত তুমি শেখ হাসিনা’ শিরোনামের লেখায় বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ‘আমাদেরই শেখ হাসিনা’ বলে পুরো দেশবাসীর যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। প্রসঙ্গত বিশেষ করে উল্লেখ সারাটা দেশের প্রধানতই তৃণমূল গ্রামীণ গণমানুষ, নবীন প্রজন্ম, সবাই এক কাতারে শামিল হয়েছেন এবং তাঁদের তার আশা-আকাক্সক্ষা-নির্ভরতার প্রতিফলন ঘোষণা করেছেন। যেন জেনে রাখি, এই ছবি তো কোনো এক ব্যক্তিমানুষ মাত্র নন, দীর্ঘকাল ব্যবধানে দেশ ‘আমার বাংলা’ কথা কয়েছে প্রতীকী শেখ হাসিনা-সত্তায়।” (ঐ, পৃ. ৪১)।
‘শেখ হাসিনা ইতিহাসের মানসকন্যা’ শিরোনামে প্রয়াত অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ভ‚মিকার প্রশংসা করেছেন। তার ভাষায়, ‘তাঁর জীবনে যে আশ্চর্যের ও অলৌকিকতার প্রকাশ আমি দেখেছি, তাতে ভাবতে বাধ্য হয়েছি, তাঁর হাত দিয়েই বাংলাদেশের ভাগ্য বিধাতা তাঁর পরম ইচ্ছার পূরণ কামনা করেন। তাঁর হাতেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি রচিত হোক। ভবিষ্যতের বাঙালি যেন বলতে পারে, তিনি ছিলেন ইতিহাসের মানসকন্যা” (ঐ, পৃ. ৪৯)।
প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ার শুধু ‘অন্তরাত্মা’র ডাকেই সাড়া দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিবন্ধে লিখেছেন, “আপনি সবার কথাই শুনুন, শত্রæ-মিত্র সবার। তবে সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার ‘অন্তরাত্মা’র সায় নিয়ে। এই ‘অন্তরাত্মা’ই আপনাকে সঠিক পথের সন্ধান দেবে। অন্য কেউ নয়” (ঐ, পৃ. ৫৪)। আমার ধারণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ‘অন্তরাত্মা’র ডাকেই শুধু সাড়া দেন। বস্তুত তেমনটিই ঘটে বলে আমরা জানি।
প্রিয় বান্ধবী বেবী মওদুদের লেখা থেকেই অনুভব করা যায় ‘শেখ হাসিনা : এক জনদরদী লড়াকু নেত্রীর প্রতিকৃতি।’ বিশ^বিদ্যালয়ে এক বিভাগে এক সঙ্গেই পড়তেন। দু’জন দুই ছাত্র সংগঠনের নেত্রী। কিন্তু চলেন এক রিকশায়। বাংলা একাডেমি ও বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরিতে একসঙ্গেই যান।
বেবী মওদুদের সঙ্গে সেই বন্ধুত্বই প্রমাণ করে ভিন্ন দল করেও একসঙ্গে চলা যায়। যদ্দিন বেঁচে ছিলেন বেবী মওদুদ তদ্দিনই ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ। একসঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর ওপর গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখাগুলো গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী মনে করেন ‘শেখ হাসিনাই দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ’ (ঐ, পৃ. ৬১)। শেখ হাসিনার শিক্ষক সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনে করতেন, ‘দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা তার কাছে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রে এবং ফলে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে, এই আশা মানুষের’ (ঐ, পৃ. ৬৯)। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যথার্থই লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনার সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য সম্ভবত বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সংবিধানে পুনঃসংযোজন’ (ঐ, পৃ. ৭২)। প্রয়াত সংস্কৃতিজন কামাল লোহানী বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছিল তাকে কি শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছেন শেখ হাসিনা সেই বিষয়ে লিখেছেন। তার ভাষায়, ‘জনগণ যদি সঙ্গে থাকেন, তবে শক্তি দেন জনগণই। জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই প্রমাণ করেছেন কবিগুরুর সেই বাক্যের মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। যিনি জনগণকে ভালোবাসেন, তাঁর কিসের ভয়?’ (ঐ, পৃ. ১০৫) বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন তোয়াব খান তার ‘তিমির হননের নেত্রী’ শিরোনামে লেখায় যথার্থই বলেছেন, ‘সংগ্রাম আর সাফল্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় জীবন। কিন্তু সান্ধ্য আইনের তিমিরাচ্ছন্ন শাসন আর নয়। তাই শেখ হাসিনা তিমির হননের নেত্রী।’ (ঐ, পৃ. ১০৮)। বাহাত্তর জন লেখকের মধ্য থেকে বয়োজ্যষ্ঠ কয়েকজনের চুম্বক কিছু কথা তুলে ধরলাম এই নিবন্ধে। ইচ্ছে থাকলেও সবার কথা তুলে ধরতে পারলাম না এই নিবন্ধে। এদের মধ্যে তিনজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির কবিতাও রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক ‘শেখ হাসিনার জন্মদিনে : ২০০৯’ দার্শনিকের মতো উচ্চারণ করেছেন, ‘সকলেই জন্ম নেয় কেউ কেউ জন্মলাভ করে, অনন্য অর্জন তার।’ যে বৃষ্টিভেজা বৈশাখের দিনে পিতৃমাতৃহীন শেখ হাসিনা পঁচাত্তর-পরবর্তী এক অন্ধকার সময়ে বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন সেদিনটিই তার প্রকৃত জন্মদিন বলে উল্লেখ করেছেন কবি। কবিরাই পারেন এমনটি বলতে। ‘মানুষেরই মুক্তিলগ্নে জন্মদিন সে ছিল আপনার, উজ্জ্বল অক্ষরে সেটি লেখা আছে ইতিহাসপটে।’ (ঐ, পৃ. ৫১৬)
‘ইলেক্ট্রার গান’ কবিতায় আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান অনুমান করতে পেরেছেন অন্ধকার ঐ সময়ে বাবার মৃত্যুর গুরুভার কি কষ্টেই না কন্যা বইছেন। কবির ভাষায়,
‘আড়ালে বিলাপ করি একা-একা ক্ষতার্ত পিতা
তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।
এমন কি হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি
নিষিদ্ধ আজ, তোমার দুহিতা কি গুরুভার বয়।’ (ঐ, পৃ. ৫১৮)
কবি নির্মলেন্দু গুণ ঠিকই আশঙ্কা করেছিলেন যে পঁচাত্তর-পরবর্তী নিকষ আঁধারে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ। ‘পথে পথে পাথর’ কবিতায় তিনি তাই লিখেছেন,
‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে
আপনি পা রেখেছেন মাত্র।
আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো।
পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরুপথ।’ (ঐ, পৃ. ৫২০)
‘গণতন্ত্রের বহ্নিশিখা শেখ হাসিনা’ বইটিতেও লেখকদের শেখ হাসিনার প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বিপুল সমাবেশ দেখতে পাই। বইটি শুরুর প্রবন্ধটির শিরোনাম : ‘শেখ হাসিনা : শান্তির দূত এবং উন্নয়নের প্রতীক।’ লিখেছেন প্রয়াত অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। শেখ হাসিনার প্রতি তার আশীর্বাদ ছিল হৃদয় নিংড়ানো। তার ভাষায়, ‘সর্বহারা শেখ হাসিনার হারানোর তো আর কিছু নেই কিন্তু জয় করার আছে সারা বিশ্ব। জননন্দিত শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় দৃঢ়প্রত্যয়ী ক্লান্তিহীন একজন রাজনৈতিক সৈনিক। উত্তরোত্তর তাঁর জয়ের খতিয়ান হোক বিস্তৃত।’ (ঐ, পৃ. ২১)। শিক্ষাবিদ অজয় রায় লিখেছেন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, অগ্রসর বাংলাদেশ ও দেশরতœ ‘শেখ হাসিনা’ প্রসঙ্গে। পঙ্কজ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘ইতিহাস নন্দিত : শেখ হাসিনা।’
শেখ হাসিনার দ্রæত সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বিষয়ে লিখেছেন রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন। ‘পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে’ প্রবন্ধে সাহিত্যিক আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু এবং শুভ বাংলাদেশ সকল অশুভতার ভেতরেও যে প্রকৃত বাংলাদেশ জেগে আছে তাঁর সাফল্যের জন্য শুভকামনা নিয়ে সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অপেক্ষায় তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে।’ (ঐ, পৃ. ২১৩)।
বাদবাকি প্রত্যেক লেখকই প্রায় একই প্রত্যাশা করেছেন শেখ হাসিনার কাছ থেকে। তারা এও বলেছেন যে জীবন তার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বারে বারে তারা আঘাত হেনেছে তাকে নিঃশেষ করার জন্য। তবু তিনি নিরাশ হননি। ফের শক্তি সঞ্চয় করে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে। মিসরীয় লেখক মুহসিন আল আরশি লিখেছেন ‘হাসিনা হাকাইক ওয়া আসাতির’। (২০১৭) বইটি বাংলা করেছেন ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, কামরুল হাসান ও আব্দুল্লাহ জোবায়ের। নাম দিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনা : উপাখ্যান ও বাস্তবতা’ (২০১৮) এ বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে লেখা এই বইতে লেখক মিসরীয় ফারাও ও গ্রিকদের ট্র্যাজেডির সমতুল্য বাংলাদেশের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘একজন যোগ্য নেত্রী হওয়ায় শেখ হাসিনা একাই দরিদ্র ও মুসলিম জাতিটির অধিকার রক্ষায় অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন আর সমস্ত মুসলিম আর মানবতার হৃদয়গুলো তাঁর আহ্বানে সমবেত হয়েছে। পরবর্তীকালে ঐ অত্যাচারীরা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।’ (ঐ, পৃ. ১৩)। একজন বিদেশি লেখকেরও চোখ এড়ায়নি শেখ হাসিনার সংগ্রামমুখর জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের দিক।
আজো তিনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে করেই সামনের দিকে হাঁটছেন। পথের পাথর ডিঙিয়েই তাকে অতি সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে সামনের দিকে। চলমান মহামারি যেভাবে বিশ্বকে ঢেকে ফেলেছে অনিশ্চিত আঁধারে তাকেও ভেদ করে তিনি এগিয়ে চলেছেন সম্মুখ পানে। সারা পৃথিবীর অর্থনীতি যখন সংকুচিত হচ্ছে তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ গতিময়। এর পেছনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা, সাহস, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রতি অগ্রাধিকার এবং সর্বোপরি জনগণের পাশে থাকার প্রত্যয়ই সবচেয়ে বেশি কাজ করে চলেছে। তমসাচ্ছন্ন এই সময়েও আলোকবর্তিকা হিসেবে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া এই বিচক্ষণ নেত্রীর জন্মদিনে রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ড. আতিউর রহমান ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ লিংক
Leave a Comment