ইতিহাসই মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছে

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

ঊনচলি্লশ বছর আগে এক অভিশপ্ত ভোরে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়। এ হত্যাকাণ্ড নিষ্ঠুরতার দিক থেকে কারবালা ও গ্রিক ট্র্যাজেডিকেও হার মানায়। বাঙালি জাতি এই দিনে হারিয়েছে তার জনক। সম্পূর্ণ আদর্শিক কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার মধ্য দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসেন, তারা ব্যক্তি মুজিবের বিরুদ্ধে যতটা ছিলেন তার চেয়ে অধিক ছিলেন মুজিবাদর্শের বিরুদ্ধ শক্তি। লন্ডনের বিখ্যাত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ২৮ আগস্ট ১৯৭৫ মন্তব্য করে, ‘বাংলাদেশের জনসাধারণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, ধর্মীয় প্রচারণা ও সামরিক শাসনের যুগে ফিরে গেছে।’ এ কথা সর্বজনবিদিত যে, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তাদের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এ পটপরিবর্তন করেছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ধারার বাইরে এসে, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত প্রগতিবাদী ও আর্থসামাজিক পদক্ষেপগুলো ধ্বংস করে প্রতিক্রিয়ার ধারায় দেশ পরিচালনা করে সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ ও পুঁজিবাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঙালি জাতিকে চিরকালের জন্য আবদ্ধ করতে চেয়েছিল। আরও পরিষ্কার করে বললে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আদলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই ১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ।
‘শেখ মুজিব’ বাঙালির হৃদয়ে শুধু একটি নাম নয়, শেখ মুজিব একটি ইতিহাস, একটি কিংবদন্তি, একটি চেতনা, একটি স্বপ্ন, একটি আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এবং এক কালোত্তীর্ণ মহাপুরুষ। তিনি জীবনভর দুঃখী মেহনতি মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক নিরঞ্জন মজুমদার লিখেছিলেন, ‘দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পঙ্ক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউবা একটি অধ্যায়, কিন্তু কেউ সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস।’ কিছু জ্ঞানপাপী ও অর্বাচীন শেখ মুজিবকে অস্বীকার করতে পারে বা খণ্ডিত করে দেখাতে পারে কিন্তু গোটা পৃথিবী জানে তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাস। তিনিই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক নেতা। ‘৭১-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সামনে থেকে যিনি সরব, গৌরব, উজ্জ্বল ও দৃঢ় নেতৃত্ব দান করেছেন তিনি ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘টাইমস’ লিখেছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ১০ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক আমলের অবসান ঘটে।’ বঙ্গবন্ধু দেশকে গড়ে তোলার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। এই অল্প সময়ে তিনি বাঙালি জাতিকে প্রশংসিত ও সর্বজন গৃহীত সংবিধান প্রদান করেন এবং বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বন্ধুসুলভ কূটনৈতিক আস্থা ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনে সার্থক হন। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অতি অল্প সময়ে দেশকে একটি কল্যাণকামী শাসনতন্ত্র উপহার দেওয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রেখে শাসনতন্ত্রের মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। প্রতিক্রিয়াশীলরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথমেই শাসনতন্ত্রের মূলনীতি, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আঘাত করে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এটি ছিল একটি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রকারীরা ঝুঁকি নিয়ে সেদিন সফল হয়েছিল। বাস্তবে তারা সেদিন কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করেনি, তারা জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও সংবিধানকে হত্যা করে। দেশকে ঠেলে দেয় অগণতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক পথে। ইতিহাস থেকে ইতিহাসের মহানায়কের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। তরুণদের দীর্ঘকাল জানতে দেওয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। ইতিহাসকে করা হয়েছে বিকৃত।
মানুষ খুন হলে সারাবিশ্বে প্রচলিত আইনে তার বিচার হয় এটাই নিয়ম। আর বঙ্গবন্ধুর খুনের যেন বিচার না হয় সে জন্য অবৈধ শাসক তৈরি করেছিল অব্যাহতি অধ্যাদেশ, যা ছিল জাতির জন্য কলঙ্কতিলক। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র অপরাধ ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি। বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন, তাই শত্রুরা তাকে ক্ষমা করেনি। ড. আনিসুজ্জামানের মতে, ‘হত্যাকারীদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের একমাত্র অপরাধ ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টি।’ ‘৭১-এ পরাজিতরা তাদের পরাজয় ও ব্যর্থতার প্রতিশোধ অনিবার্যভাবে নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল কিছু উচ্চাভিলাষী এবং এ হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা। তাদের উচ্চাভিলাষ ও তার প্রকৃতি জাতি বুঝতে পারে পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসক ও শাসন পদ্ধতি থেকে। ইতিহাসের জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শুধু বিলম্বিতই হয়নি, একে ইচ্ছাকৃতভাবে দিনের পর দিন প্রলম্বিত করা হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করে বাংলাদেশ সারাবিশ্বের কাছে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আদালত ১৫ জনকে ফাঁসির দণ্ড দেন। অন্যদিকে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চের দু’জন বিচারপতি দুই ধরনের রায় দেওয়ার পর তৃতীয় আদালত ১২ জনকে ফাঁসি ও তিনজনকে বেকসুর খালাস দেন। খুনিদের ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে তা অনুমোদন পেল না। আমাদের বিচারপতিরা এ রায় কার্যকর করার অনুমোদন দিতে বারবার বিব্রতবোধ করেছেন। এ ঘটনা জাতির জন্য এবং বিচারপতিদের জন্য কলঙ্কের অধ্যায় সৃষ্টি করে অবশেষে বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে বিবিসি টেলিভিশনের সংবাদদাতা ব্রায়ন বারন তার লিখিত সংবাদ বিবরণীতে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন তার বুলেটে বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক চিহ্ন এবং তার কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে’ (দ্য লিসনার, লন্ডন, ২৮ আগস্ট ১৯৭৫)। তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ বাস্তব সত্যে উদ্ভাসিত হয়েছে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ২১ বছর পর মামলা শুরু করে ৩৪ বছর পর জাতি দায়মুক্ত হলো।
আজ ইতিহাস ঘোষণা করছে শাশ্বত বাণী। স্বাধীনতার ইতিহাসকে স্তব্ধ করা যাবে না, জাতির জনকের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও অবদানকে বিকৃত বা হেয় করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না। এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় যার স্থান, তাকে যেমন সরকারি গেজেট দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি কোনো সরকারি ফরমান বা ঘোষণা দিয়ে তার নাম মুছে ফেলা যায় না কালের ইতিহাস থেকে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি হাজার বছর। তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। ভাবীকাল তাকে স্বীকৃতি দেবে মহাকালের মহানায়করূপে। তিনিও ইতিহাসে অক্ষয় ধ্রুবতারার মতো ভাস্বর হয়ে থাকবেন অনাদিকাল। বাংলার জনগণের কাছে তিনি বন্ধু, জাতির কাছে তিনি পিতা। বিদেশিদের কাছে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তাই কালের ইতিহাস তাকে যুগের বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, ইতিহাসের বরপুত্র ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষকে ইতিহাসই তার প্রাপ্য মর্যাদার আসনে বসিয়ে দিয়েছে। সব ব্যর্থতা ও বাধা জয় করে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা রচনা করতে পারলেই তার প্রতি সর্বোত্তম শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সেই স্বপ্নের সোনার বাংলায় থাকবে না হানাহানি, অরাজকতা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও দুঃখের অমানিশা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গর্জে উঠুক জয় বাংলার জয়ধ্বনি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনির্বাণ শিখা।

বাপ্পু সিদ্দিকী, প্রধান শিক্ষক, মধুপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মধুপুর, টাঙ্গাইল
সমকাল, ২২ আগস্ট ২০১৪, লিঙ্ক

আরও পড়ুন