মানুষকে ভালবাসতে পারে এমন একজন হৃদয়বান মানুষকে হারিয়েছি আমরা। যে শিশুর চোখের তারায় ছিল অপার সম্ভাবনা, ছিল আকাশসম আলো, উদয়ের আগেই তাকে ঝরে যেতে হলো।
বাংলার পথে পথে ইতিহাস ছড়ানো। ক্ষমতার অলিন্দে কত যে ষড়যন্ত্র, কত যে রক্তাক্ত ঘটনা। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে মানুষ তার সারা জীবনকে সঁপেছেন দেশের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, সেই মানুষটাকে তো হত্যা করেছেই, তার পরিবারকেও ছাড় দেয়নি ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেল, যার বয়স ছিল তখন মাত্র ১১ বছর, খুনিরা তাকেও রেহাই দেয়নি।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়িতেই রাসেলের জন্ম। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। কেন রাসেল নাম হলো তা জানা যায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগমের এক লেখা থেকে। তিনি লিখছেন- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বারট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। রাসেলের বই পড়ে তিনি তার ছায়াসঙ্গী প্রিয়তমা স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণুকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। এই ফিলোসফি শুনে শুনে রেণু এতটাই বারট্রান্ড রাসেলের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তার নাম অনুসারে নিজের ছোট ছেলে জন্মের পর তার নাম রাখলেন রাসেল।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ষাটের দশক থেকে আমরা বাঙালিরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের স্বপ্ন দেখে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। সেই সময় আমাদের যে প্রখরতর সমাজ-সচেতনতা ছিল তা আজকের দিনে ভাবলে অবাক হতে হয়। তবে একটা অংশের হৃদয়ে হিংসার বিষ ছিল। ১৯৭১-এর সেই পরাজিত শক্তি, পাকিস্তানিদের দোসররা প্রতিশোধ নিয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এমনই সেই হিংসা যে তারা ১১ বছরের ছোট্ট শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মা– কাউকে ছাড় দেয়নি। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড আর কোথাও ঘটেনি। বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিতে নিতে শিশু রাসেলকে প্রতিটি লাশের সামনে মানসিকভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে ঘাতকরা।
প্রতিবাদ গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বহু প্রতিবাদ হয়েছে। তার শাসন কাজ নিয়ে অসন্তোষ থাকলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার প্রতিবাদ হতে পারত। কিন্তু ১৯৭৫ সালে যারা এমন প্রতিশোধের খেলায় মেতেছিল তারা স্বাভাবিক কোনো মানুষ ছিল না। তারা কতটা পৈশাচিক ছিল যে, একান্ত আপনজনের রক্তমাখা নীরব, নিথর দেহগুলো দেখিয়ে দেখিয়ে ঘাতকরা মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতালায় নিয়ে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে নৃসংশভাবে হত্যা করে শিশু রাসেলকে।
বঙ্গবন্ধুহত্যা মামলার বাদী পিএ মুহিতুল ইসলামের বর্ণনায়- ‘ঘাতকদের অভিযানের শেষ শিকার ছিল শিশু রাসেল। সবাইকে হত্যার পর তাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। এ সময় রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চায়, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে? এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ঘাতক আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে রাসেলকে পুলিশ বক্সের ভেতরে আটকায়। এরপর দুই ঘাতক রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শুনতে পাই’।
শেখ রাসেলের ৫৬তম জন্মবার্ষিকীতে ছোট ভাইয়ের স্মৃতি হাতড়ে কাঁদবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- ‘ঠিক যেই মুহূর্তে রাসেল জন্মায় তখন আব্বা খুব ব্যস্ত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ফাতেমা জিন্নাহ প্রার্থী। তিনি সেই নির্বাচনে প্রচারণার কাজে চট্টগ্রামে ছিলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। রাসেলের জন্ম হওয়ার পর আমরা তাকে খবর দিই’। আরও বলেছিলেন- ‘আমরা চার ভাই-বোন উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিলাম এই ছোট্ট শিশুটির জন্ম মুহূর্তটা এবং তারপর তাকে কোলে নেওয়া। তাকে লালন-পালন করা তার পাশে থাকা। জাতির জনক ৬৭ সালে যখন কারাগারে গেলেন রাসেলের বয়স তখন দুই বছরও হয়নি। তখনই সে বাবার স্নেহ বঞ্চিত হলো’।
বড় বোন, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকেই জানতে পাই, বঙ্গবন্ধু দরিদ্র মানুষের সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খেতেন। তিনি সব সময় তা করতেন। ঠিক সেই গুণটি রাসেলের মধ্যেও ছিল। গ্রামে গেলে দরিদ্র শিশুদের যে কিছু দিতে হবে, তা সে চিন্তা করত। রাসেলের খুব শখ ছিল বড় হয়ে সে আর্মি অফিসার হবে। সে কাঠের বন্দুক বানাত। সেটা নিয়ে খেলা করত।
আমরা একজন সেনানায়ককে হারিয়েছি, সূর্য সন্তানকে হারিয়েছি, মানুষকে ভালবাসতে পারে এমন একজন হৃদয়বান মানুষকে হারিয়েছি। যে শিশুর চোখের তারায় ছিল অপার সম্ভাবনা, ছিল আকাশসম আলো, উদয়ের আগেই তাকে ঝরে যেতে হলো। আমরা শেখ রাসেলকে ভালবাসি, আমাদের অন্তরজুড়ে আছে শেখ রাসেল, আমাদের শুভেচ্ছা পৌঁছে যাক তার কাছে। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৫৬ বছর। তিনি হয়তো আজ নেতৃত্বের আসনে থাকতেন। শেখ রাসেল নিয়ে আমাদের গবেষণামূলক তেমন কোনও গ্রন্থ চোখে পড়ে না। সেটাই হোক তার জন্মদিন বড় চাওয়া।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ১৮ অক্টোবর ২০২০ লিংক