ইতিহাসের একটি নিষ্পাপ শিশুর নাম শেখ রাসেল

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ সাল। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার বাড়িকে আলোকিত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার আদরের ছোট সন্তান হয়ে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিল তাঁর নাম রাসেল। দীর্ঘ সাত বছর পর পরিবারে নতুন অতিথি আসার খবরে সবার মধ্যেই সে কি আনন্দ! তখন পিতা মুজিব বাড়িতে ছিলেন না। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে চট্টগ্রামে ছিলেন।

রাসেল নামকরণেরও একটি ইতিহাস আছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বই পড়ার প্রতি ছিল প্রচুর নেশা। বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ছিলেন একজন ভক্ত। বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের বিশ্বনেতা। বিশ্ব শান্তির জন্য গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অব হান্ড্রেট’। শেখ রাসেলের জন্মের দু-বছর পূর্বে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন দ্বারপ্রান্তে তখন শান্তির পতাকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা আগেই সিন্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে তাঁদের যদি পুত্র সন্তান হয় তাহলে শান্তির দূত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখবেন রাসেল।বাবা মুজিব হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর ছোট ছেলে আপন প্রতিভায় একদিন দীপ্ত হয়ে উঠবে। হবেন লেখক, দার্শনিক কিংবা বিশ্বশান্তির নতুন কোন কান্ডারী।ছোট্ট শহীদ রাসেলের স্বল্প সময়ের জীবন বিশ্লেষন করলে আমরা সেটাই দেখতে পাই। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী,মানবিক ও রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি।

শেখ রাসেলের যখন দেড় বছরের কিছু বেশি বয়স সেসময়টায় বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন,তখন পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এনে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য প্রেরণ করেন।শিশু রাসেল তখন প্রথম বারের মত মায়ের সাথে কারাগারে পিতাকে দেখতে যান।এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় বলেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারী দুই বছরের কম বয়সী ছেলে এসে বলে,আব্বা বালি চলো। কী উত্তর দিব ওকে? ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ওতো বুঝেনা আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম তোমার মা’র বাড়ি তুমি যাও,আমি আমার বাড়ি থাকি।আবার আমাকে দেখতে এসো।ও কি বুঝতে চায়? কি করে আমাকে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষান প্রাচীর থেকে’।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তাঁর আদরের ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বই থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। তিনি বলেছেন, আব্বার সাথে প্রতি পনের দিন পর পর আমরা দেখা করতে যেতাম।রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না।খুব কান্না কাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল আব্বার বাসা জেলখানায় আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা আমাদের বাসায় চলে যাব। বেশ কষ্ট করে ওকে নিয়ে আসতে হত। তখন আব্বার মনের অবস্থা যে কি হত তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায়ও আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাত,আমিই তোমার আব্বা। আমাকেই আব্বা বলে ডাক। এভাবে একটা সময় মাকেই আব্বা বলে ডাকত। একদিন তো আমি আব্বাকে ডাকছি শুনে ও বলে উঠল হাসু আপা,হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমিও একটু আব্বা বলে ডাকি।

রাসেল পিতার সান্নিধ্য বেশি না পেলেও যখন পেতেন তখনই পিতাকে সবসময় অনুকরণ ও অনুসরণ করতেন।পিতার জামা-জুতা হাঁটার ষ্টাইল সব কিছুই অনুকরণ করতেন।বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পোশাক ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। সেজন্য রাসেলেরও ছোট লুঙ্গি ছিল। বঙ্গবন্ধুর চশমাটা মাঝে মাঝে নিজের চোখে নিয়ে মজা করত। একদিন বঙ্গবন্ধু বন্যা দুর্গতদের দেখতে পায়জামা পাঞ্জাবির সাথে জুতা পরে বের হচ্ছেন দেখে রাসেল একজোড়া স্যান্ডেল এনে দিলেন। তখন পিতা বললেন, বাবা আমাকে তো কাদামাটিতে হাঁটতে হবে, সেজন্য জুতা পড়েছি। তখন রাসেল বলল আরেক জোড়া সঙ্গে নিয়ে যাও। বঙ্গবন্ধুও যখন সময় পেয়েছেন তখনই রাসেলকে সময় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিভিন্ন দেশ সফরে যেতেন তখন রাসেলকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল সাইকেল। দুটো সাইকেল ছিল। একটি লাল,অন্যটি নীল রংয়ের।এখনও বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে সাইকেল দুটো সংরক্ষিত আছে। অন্য একটি বড় গুন ছিল আতিথেয়তা।যখন টুঙ্গীপাড়ায় যেতেন সমবয়সী সকল বন্ধুদেরকে তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। আতিথেয়তা বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।

রাসেল ছিল খুবেই চঞ্চল প্রকৃতির। সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখত। চার বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবন শুরু হয়।দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়,মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহ শিক্ষিকা রাখা হয়।তিনি ছিলেন গীতালি দাসগুপ্তা। চঞ্চল প্রকৃতির রাসেলের কথাই শিক্ষিকাকে শুনতে হতো,নইলে সে পড়াশুনা করতে মনোযোগী হতো না।শিক্ষিকাও আদর করে তাঁকে ম্যানেজ করেই শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকা যখন পড়াতে আসতেন তখনই তাকে বাধ্যতামূলক দুটো মিষ্টি খেতে হতো,তিনি খেতে না চাইলে,রাসেলও বই পড়তে চাইতেন না। এভাবেই চলছিল শেখ রাসেলের বাল্যকাল।

শহীদ রাসেলের মৃত্যুর দিনটিও পিতার আদর্শে উজ্জ্বল হওয়ার কথা ছিল।১৫ আগস্ট সমাবর্তন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল আচার্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট জানানোর জন্য বাছাই করা হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ৬ জন সদস্যকে। তাদের মধ্যে অন্যতম চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শেখ রিসালউদ্দিন(রাসেল)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আর স্যালুট জানানো হয়নি। সেদিন যদি শেখ রাসেল শহীদ না হতেন তাহলে আজ তিনি ৫৬ বছরে পদার্পণ করতেন। তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর প্রিয় হাসু আপার পাশে থেকে আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে পাশে থেকে কাজ করতেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা হারিয়েছেন আদরের প্রিয় ছোট ভাইকে আর বাংলাদেশ হারিয়েছিল একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান সন্তানকে। শেখ রাসেল আজ প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণদের কাছে ভালবাসার নাম। একটি নিষ্পাপ শিশু হিসেবেই চিরকাল ইতিহাসে থাকবে। মানবিক চেতনা বোধ সম্পন্ন মানুষেরা শহীদ শেখ রাসেলের বেদনার কথা হৃদয়ে ধারণ করে চিরদিন শিশুদের জন্য কাজ করে যাবে। ইতিহাসের মহা শিশু হয়েই বেঁচে থাকবেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।

খুনিরা শেখ রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তাদের সে অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল সবসময় বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের সব শিশুর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে। অবহেলিত,অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে। শহীদ শেখ রাসেল তোমার মৃত্যু নাই, তুমি বেঁচে আছ কোটি শিশুর প্রদীপ হয়ে।
শুভ জন্মদিন, শহীদ শেখ রাসেল।

 

তাপস হালদার ১৮ অক্টোবর ২০২০ লিংক

আরও পড়ুন