বঙ্গবন্ধুর শেষ অটোগ্রাফ

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালিতে। গণভবনের রান্নাঘরের স্টোরকিপারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এই সুবাদেই ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন মোশাররফ। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঠিক আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় গণভবনে জাতির পিতাকে সর্বশেষ দেখেছিলেন গণভবনের এই কর্মচারী। তবে ওইদিনই যে শেষ দেখা হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। সেদিনও প্রতিদিনের মতোই বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে দেখেছেন গণভবনের ওই কর্মচারী। দেখেছেন পাইপ টানতে, লেকের পাড়ে হাঁটতে।

সেদিন গণভবন ত্যাগ করার আগে গণভবনের কর্মচারীদের এক দারুণ সারপ্রাইজ দিয়ে অবাক করে যান বঙ্গবন্ধু। নিজের কয়েকটি ছবিতে অটোগ্রাফ দিয়ে কন্ট্রোলার সুবেদার মেজর আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, এই ছবিগুলো ওদের দিয়ে দিস। গণভবনের আরও কয়েকজন কর্মচারীর মতো বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ দিনের শেষ অটোগ্রাফযুক্ত একটি ছবির মালিক হন স্টোরকিপার মোশাররফ। তার কাছে এই ছবি এখন অমূল্য সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর হাতের শেষ ছোঁয়া জড়ানো ছবিটি আজও যত্নে রয়েছে মোশাররফের কাছে। প্রায় ২০টি বছর ছবিটি অনেকটা লুকিয়েই রাখতে হয়েছিল মোশাররফকে। তাই ছবিতে কিছুটা ফাঙ্গাস পড়েছে। ছবিটি দেখিয়ে দেখিয়ে প্রবীণ মোশাররফ হোসেন তার ছেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সোয়েব-উর-রহমানকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতিজড়িত নানা গল্প শোনান।

এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতর্ষে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদকের কাছে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফযুক্ত ছবিটি পাওয়ার গল্প বলেছেন মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। ছবির গল্পের সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন সেসব অনেক ঘটনাও। সেদিনের তরুণ মোশাররফ আজ প্রবীণ। রোগে ভুগে অনেকটাই কাতর। কথা বলতেও কষ্ট হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিটুকু প্রকাশ করার সময় একটুও যেন কষ্টবোধ হয়নি তার। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার টান বোঝাতে গিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘ধর্ম-কর্ম করি বলে আমার ঘরে কোনো ছবি টানানো নেই। তবুও দুটি ছবি টানানো আছে। একটি বঙ্গবন্ধুর হাতের অটোগ্রাফযুক্ত সেই ছবি, আরেকটি আমার মায়ের ছবি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন তার স্মৃতিচারণ করে গণভবনের স্টোরকিপার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘চাকরি করাকালীন বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা পেয়েছি তা কখনো ভোলা যাবে না।’

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টও ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাঠানো দুপুরের খাবার গণভবনে বসেই খেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ওইদিনও অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে দুপুরের খাবার পরিবেশনের কাজে মোশাররফও ছিলেন। ওইদিন বিকেলের ছবি পাওয়ার ঘটনাটিই এখন চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তার কাছে। তিনি বলেন, সেদিনটি ভীষণ আনন্দেরও ছিল। দেশের রাষ্ট্রপতি কর্মচারীদের নিজের অটোগ্রাফযুক্ত ছবি দিলেন। আর

ঠিক পরের দিনটাতে, ১৫ আগস্টই এই ছবি হয়ে উঠল চির-বেদনার। মোশাররফ বলতে থাকেন, ‘বঙ্গবন্ধু নেই, তার হাতের শেষ ছোঁয়া, শেষ স্মৃতি রয়ে গেল আমার কাছে। ১৫ আগস্ট যখন খুনিরা গণভবনে ঢুকল, শেষ স্মৃতিটুকু লুকিয়ে রাখলাম। যেন সেটা তাদের নজরে না পড়ে। পরে বাড়ি এসে বাড়ির দলিলপত্রের মধ্যে যত্ন করে ছবিটা লুকিয়ে রাখি।’

দায়িত্ব স্টোরকিপারের থাকলেও গণভবনে আগত অতিথিদের আতিথেয়তা-আপ্যায়নের দেখভালের দায়িত্বও ছিল মোশাররফ হোসেনের। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে বসবাস করলেও অফিস করতেন গণভবনে। সেই সুযোগে প্রায় তিন বছর খুব কাছ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। শুধু দেখাই নয়, চেনা-জানা, বঙ্গবন্ধুর অন্তরাত্মা বোঝা, ভেতরের মহানুভবতা বোঝার সুযোগ হয়েছে। সেই বোধ থেকেই মোশাররফ দাবি করে বলেন, ‘ধনী-গরিব সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছে ছিলেন এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কাছে কে রাজা, কে প্রজা তার কোনো ভেদাভেদ দেখিনি।’

স্মৃতিচারণায় স্টোরকিপার মোশাররফ আরও বলেন, দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কথা, ভালো আছিস? খেয়েছিস? ওই খায়ের ওদের ঠিকঠাকভাবে দেখাশোনা করিস? বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে তুই শব্দটিই সবচেয়ে আপন মনে হতো। আমি যতদিন দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে, সবাইকেই তুই বলে সম্বোধন করতে। দুই একজনের ক্ষেত্রে তুমি বলতে শুনেছি। সে হোক বয়স্ক হোক তরুণ। একদিন গণভবনের লেকের পাশে হাঁটতে গিয়ে সুঠাম দেহের হারুন নামে গণভবনের এক কর্মচারীকে দেখেন বঙ্গবন্ধু। কাছে ডেকে তাকে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর নাম কী? হারুন জবাবে তার নাম বলেন। বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোর বাড়ি কোথায়? হারুন বলেন ফরিদপুর। ওখানে কোথায়? মধুপুর। তুই এখানে চাকরি করিস কেন? তোর যে শরীর-চেহারা তোর তো আর্মিতে চাকরি করার কথা। আরেক দিন বিকালে গণভবনের কর্মচারী রেজাউল নামে একজন বঙ্গবন্ধুকে চা দিচ্ছিলেন। এ সময় রেজাউলকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর চেহারা মলিন কেন? উত্তরে রেজাউল বলেন, স্যার বেতন হয় না তিন মাস। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোলার আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠান এবং জানতে চান ওদের বেতন হয় না কেন? খায়ের বলেন, জটিলতা আছে। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ বলেন, আমি কিচ্ছু বুঝি না একদিনের মধ্যে বেতন হওয়া চাই। মোশাররফ বলেন, একদিন বাদেই বেতন হয়েছে। ঘটনাগুলো বলার কারণ হলোÑ বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা ছিলেন যার দৃষ্টিভঙ্গি ধনী-গরিব, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তার চোখে সমান ছিল।

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের একটি ঘটনা বলতে গিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ১৯৭৪ সালের ১ মার্চ আমি বিয়ে করি। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের কোনো একদিন, তারিখ ঠিক মনে নেই। দুপুর বেলায় বঙ্গবন্ধু যখন খেতে বসলেন তখন বিয়ের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিই। অবশ্য আমার সহকারী কন্ট্রোলার সুবেদার কাজী হাসানুজ্জামানের কথামতো বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সহকারী কন্ট্রোলার যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন আমি তখন ওই রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ের কথা শুনেই বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন। জানতে চাইলেন কোথায় বিয়ে করছিস? বউ কী করে, শ্বশুর কী করে এমন অনেক প্রশ্ন? উত্তর দেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমদকে ডেকে বললেন, ওকে এক হাজার টাকা দিয়ে দে। আর আমাকে বললেন, ‘তোর বউকে একটা বেনারসি শাড়ি ও একটা ঘড়ি কিনে দিস এ টাকায়।’ এই হলো বঙ্গবন্ধু। মোশাররফ বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথামতো বউকে বেনারসি শাড়ি কিনেও দিয়েছি। চাকরি থাকাকালীন অনেক রাষ্ট্রপতি দেখেছি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো আর কাউকে দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসায় রকমফের দেখিনি।

স্মৃতিচারণ করতে করতে মোশাররফ আবারও পঁচাত্তরের ১৪ আগস্টে ফিরে যান। বলেন, বঙ্গবন্ধুর খাবারে সবসময়ই দেশি মাছ থাকত। পাতলা ডাল ছিল তার পছন্দের। বঙ্গবন্ধুর খাওয়া শেষে বেঁচে যাওয়া ওই ডাল কে খাবে তা নিয়ে গণভবনের কর্মচারীদের মধ্যে রীতিমতো লুকোচুরি খেলা হতো। সেই ডাল এতই সুস্বাদু ছিল, সবারই পছন্দ ছিল ওই পাতলা ডাল। আর নাস্তায় সমুচা একটু বেশিই পছন্দ ছিল বঙ্গবন্ধুর। মোশাররফ আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ছোট্ট জয়কেও (সজীব ওয়াজেদ জয়) মাঝে মাঝে গণভবনে নিয়ে আসতেন বঙ্গবন্ধু। গণভবনের ভেতরে পশ্চিম পাশের দক্ষিণ ওয়ালের সঙ্গে ময়ূরের ঘর ছিল। সেখানে জয়কে নিয়ে গিয়ে ময়ুর নাচ দেখাতেন বঙ্গবন্ধু।

১৫ আগস্ট ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি গণভবনের বাউন্ডারি ঘেঁষে ট্যাঙ্ক দাঁড়ানো। কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ বাদে রেডিও ছেড়ে প্রথম এ খবর পাই। বেলা ১০/১১টা নাগাদ খুনি মেজর ডালিম ও মোসলেমউদ্দিন গণভবনে প্রবেশ করে দলবল নিয়ে। বিভিন্ন রুমে তল্লাশি করে আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। গণভবনের কর্মকর্তারা সবাই সবার পরিচয় দিলে খুনির দল আমাদের ছেড়ে দেয়। তবে আমিসহ আরও দুই একজনকে দুইমাস নজরবন্দি করে রাখে। পরে বঙ্গভবনে চলে যাই। ওখানে আর চাকরি করিনি।

লেখক : পাভেল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক

সূত্র: দেশ রূপান্তর

আরও পড়ুন