বঙ্গবন্ধু চাইতেন, শিশুরা বড় হবে হেসে-খেলে

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন জনগণের তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করাই ছিল দুরূহ, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অবস্থাও নাজকু, সেই সময় প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছিলেন রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেন তিনি। স্বল্প সময়ের মধ্যে ১১ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজও করেছিলেন।

লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে শিশুর বিকাশে বঙ্গবন্ধু মনোযোগী ছিলেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম।

বাঙালির স্বাধীনতার স্থপতির জন্মশতবার্ষিকীতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলতেন, শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে। আর সে কারণেই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে মনোযোগী হয়েছিলেন তিনি।”

“বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এ দেশের শিশুরা শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচুক। পড়াশুনার সাথে সাথে তারা শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করতে করতে বড় হোক। উনি এতটাই সংস্কৃতিমনা ছিলেন যে, উনি চাইতেন শিশুরা হাসবে, গাইবে, ছবি আঁকবে, গল্প লিখবে। শিশুরা হেসে-খেলে বড় হবে। এবং এজন্য উনি শিশুদের জন্য নির্দেশনাও দিতেন স্কুল বা সংগঠনগুলোতে। কচিকাঁচার মেলা বা তার সময়ে যেসব সংগঠন ছিল, সেগুলোতে। উনি বলতেন, এগুলোর খুব ভালো কাজ হতে হবে। কারণ সংস্কৃতি চর্চা না করলে সত্যিকার অর্থে ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে উঠতে পারবে না- এগুলো উনি বলতেন। এই যে মানুষটা শিশুদের জন্য সব সময় ভাবতেন, শিশুরাই ভবিষ্যৎ- এটাই বঙ্গবন্ধু।”

বর্তমান সরকার শিশুদের জন্য অনেক কিছু করছে মন্তব্য করে লাকী ইনাম বলেন, “সেগুলোর সব কিছুর সূচনা বঙ্গবন্ধু করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু খুব অল্প সময় পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদি আরও সময় পেতেন, উনি অনেক কিছু করে যেতেন শিশুদের জন্যে। সাড়ে তিন বছরে তিনি বাংলাদেশকে শূন্য থেকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়েছিলেন। যে জায়গাটায় দাঁড় করিয়েছিলেন, সেখান থেকে এই পর্যায়ে আমরা এত বছরে আসলাম।

“উনি প্রত্যেকটা জায়গা ধরে ধরে নির্দেশনা দিয়েছেন, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ, শিশু সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিশু সংগঠন, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের সুবিধাগুলোর ভিত্তি কিন্তু উনিই করে গেছেন। উনি চিন্তা ভাবনায় অনেক দূরদর্শী ছিলেন বলেই এসব চিন্তা করে গেছেন। উনি জানতেন, একটা দেশের শিশুদের ভিত্তি যদি তৈরি করতে না পারি, তাহলে সে জাতি কখনও ভালো নাগরিক পাবে না।”

শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “উনার হাসিটা ছিল অমলিন, উনার দিকে শিশুরা ছুটে যেত। তখনকার যেসব শিশুরা বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানে আসত, তারা বঙ্গবন্ধুর সাথে হাত মেলানোর জন্য, তার কাছে যাওয়ার জন্য, এত আগ্রহী ছিল তারা ছুটে যেত। আর বঙ্গবন্ধুও তার অমলিন হাসি দিয়ে বরণ করে নিতেন।”

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে বঙ্গবন্ধু সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলেছিলেন। নিরক্ষরতা দূর করার পাশাপাশি পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালুর কথাও বলেন তিনি। দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখার কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপে। তার সরকারের শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার পদক্ষেপগুলো উঠে এসেছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ গ্রন্থের ‘সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের হাতে প্রাথমিক শিক্ষা’ প্রবন্ধে।

তিনি লিখেছেন, ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রস্তাব করা হয়, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় ১৯৭৩-৭৮ সালে দেশে ৫০০০ নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি হবে। ১৯৭৪ সালে কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করে, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করা হোক। এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে এই ৮ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করা হবে।

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণে সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিধান রাখেন। নিরক্ষরতা দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও সংবিধানে বলা হয়।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের “The Primary Schools (Taking Over) Act ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর সময়েই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই, অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণ করা হত শিশুদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ্ব করতে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগও দিয়েছিলেন তিনি। গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোশাকও দেওয়া হত।

বাংলাদেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে যে সাফল্য, তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর এসব পদক্ষেপের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচা‌র্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু যে সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন, সেই সাড়ে তিন বছরের মাঝে তিনি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, এটা আমরা উপলব্ধি করি। কারণ যখন ’৭২ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তখন দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার একেবারে শূন্য ছিল।

“সেই পর্যায়ে তিনি শিক্ষাকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এসেছেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি সরকারের এখতিয়ারে নিয়ে আসলেন, তার মানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, স্কুল পরিচালনার খরচ রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। সার্বিকভাবে তিনি এটা করলেন।”

অধ্যাপক আরেফিনের মতে, প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

“বঙ্গবন্ধু সংবিধানে যুক্ত করলেন, শিক্ষা হবে প্রজাতন্ত্রের সকল শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক। বহু বিত্তহীন ও দরিদ্র পরিবার আছে, যারা দুই বেলা খেতে পায় না, তারা শিশুদের স্কুলে পাঠাবে কীভাবে? তাদের তো অর্থ নাই- সেজন্যই তিনি করলেন সবার জন্য অবৈতনিক। বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একমুখী।
“বঙ্গবন্ধুর যে দূরদৃষ্টি, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসন চালাতে গিয়ে প্রথমেই তিনি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করলেন। শিক্ষা একটি রাষ্ট্রের ভিত রচনা করে, সে কারণেই তিনি প্রথমেই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে কোনো রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে রাখেননি। সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়েছেন।”

১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদাকে সভাপতি করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কমিশনের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনেরই প্রতিফলন ঘটে। যেখানে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সুপারিশ করা হয়।

আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “কমিশনের রিপোর্টে ছিল, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, যথেষ্ট নয়। এটা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে হবে। আর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির মাধ্যমিক শিক্ষায় জেনারেল স্ট্রিম থাকবে, কারিগরি স্ট্রিম থাকবে; শিক্ষাটা বহুমুখী হয়ে যাবে। দ্বাদশ শ্রেণির পর থেকে হবে উচ্চ শিক্ষা। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাটা হবে একমুখী, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু ওই সুপারিশ বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নাই, কারণ তার আগেই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

“এইভাবে যদি আমরা দেখি, তাহলে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টটাই পরবর্তীকালে ২০১০ সালে শেখ হাসিনা প্রশাসন চূড়ান্ত করলেন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়েছে। এই সুপারিশটা কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের ছিল।”

তিনি বলেন, “২০১০ পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে কোন শিক্ষা নীতি ছাড়া। শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে একটি প্রজাতন্ত্রের চোখ। সেই চোখ বন্ধ ছিল। অন্ধের মত আমরা এগিয়ে গিয়েছি। সেই কারণে আমরা সঠিক শিক্ষা দিতে পারি নাই, এটা আমাদের ব্যর্থতা। ২০১০ সাল থেকে শিক্ষা নীতি চালু হয়েছে, এই শিক্ষা নীতি যখন পরিপূর্ণভাবে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব, তখন বলতে পারব যে, একটি শিক্ষা নীতি আমরা অনুসরণ করছি।”

শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মনোভাব বোঝাতে শিশুদের নিয়ে তার একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

তিনি বলেন, “১৯৬২ সালে কচিকাঁচার মেলার পক্ষ থেকে প্রেস ক্লাবে শিশু আনন্দমেলা হয়েছিল। তখন তিনি বঙ্গবন্ধু না, আমাদের তরুণ নেতা। তাকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, উনি এসেছিলেন। তখন দেখা গেল, তিনি যেখানেই যাচ্ছিলেন, সেখানে ছেড়া কাঁথা গায়ে দেওয়া এক লোক যাচ্ছেন। মেলায় আমাদের একটি গোয়েন্দা বাহিনীও ছিল। সুলতানা কামালের নেতৃত্বে সেই গোয়েন্দা বাহিনী ওই লোকটাকে ধরে নিয়ে আসল।

“পরে তার গায়ের কাঁথা সরিয়ে দেখা গেল, তার কাছে মেলার ম্যাপ আছে, আর শেখ সাহেব কোন গেইট দিয়ে ঢুকতে পারে, সেটা আছে। আমরা খুব উত্তেজিত, সুলতানা কামালও ছাড়বেন না। তখন বঙ্গবন্ধু তার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, চান্দু আমি বাচ্চাদের সাথে একটু আনন্দ করতে আসছি, এইখানেও আমার পেছনে পেছনে আসছ? ঠিক আছে যা যা ভাগ।”

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শিশুদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব দেন জানিয়ে শামসুজ্জামান খান বলেন, “তিনি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হয়েও স্বাধীনতার পর কচিকাঁচার মেলার অনুষ্ঠানগুলোতে আসতেন। উনি যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের জন্য বাকশাল করলেন, তখন কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘরকে একত্রিত করে দুটাকে সরকারি শিশু প্রতিষ্ঠান করা হল।
“শিশুদের দিকে কতটা নজর ছিল যে, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বা বাকশাল ঘোষণার সময় এই দুটি প্রতিষ্ঠান যেহেতু প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক তাদের দিয়ে তিনি জাতীয় শিশু সংগঠন গড়ে দিয়েছেন।”

“এসব পদক্ষেপের বাইরেও বঙ্গবন্ধুর শিশুদের প্রতি টান ছিল অনন্য। শিশুদের প্রতি তার সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ছিল উল্লেখ করার মতো,” বলেন বঙ্গবন্ধু গবেষক শামসুজ্জামান খান।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কেন শিশু দিবস?

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করাকে তার কর্মের প্রতি সম্মান দেখানো হিসেবে দেখেন শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ, যাকে ছাড়া বাংলাদেশ কল্পনাও করা যায় না। তিনি যে ত্যাগ-তিতীক্ষা করেছেন, সাধারণ মানুষের জন্য ওনার ভালোবাসা অল্প বয়স থেকেই। তিনি অবিসংবাদিত নেতা। এ রকম একজন মানুষ-বাংলাদেশ বলতে যাকে বোঝায় এবং শিশুরাই হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ, তো এটা খুব রিলেটেড একটা ধারণা যে মানুষটির জন্মদিনকে আমরা শিশু দিবস হিসেবে কেন ভাবব না?

লেখক-অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলায় প্রথম এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন জানিয়ে লাকী ইনাম বলেন, “নীতিগতভাবে আমি মনে করি, যে কোনো দেশের একজন নেতা যার নামে, যার কর্মে যার ত্যাগে একটি দেশের সৃষ্টি হয়, তার জন্মদিনকে শিশুদের সাথে যুক্ত করা সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত।

“কারণ শিশুরাই বড় হয়ে একদিন নেতৃত্ব দেবে, দেশ চালাবে। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, উনার জন্মদিন শিশু দিবস হবে না তো কার জন্মদিনে হবে?”

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণার সময় শিশু একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন গোলাম কিবরিয়া।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্বলিত কোনো অনুষ্ঠান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে তখন থেকে কিছু কাজ শুরু হয়। যেমন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শিশুরা যেন অনুপ্রাণিত হয় সেজন্য এই দিনে শিশু দিবস পালন করা হয়। যেমন- ভারতে জওহুরলাল নেহেরুর জন্মদিনে শিশু দিবস।

“আমরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করি। উনি এ দেশটা স্বাধীন করে দিয়েছেন, উনার সম্পর্কে যেন আবাল-বৃদ্ধবনিতা সবাই জানতে পারে, এটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুজিববর্ষ পালন করা হচ্ছে কেন? বঙ্গবন্ধুকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। যদি আলাদা দিনে শিশু দিবস পালন হত তাহলে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে যে গুরুত্বটা পাচ্ছে- সেটা তো পেত না।”

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার অর্থ হল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানা, বাংলাদেশ সম্পর্কে জানা। বঙ্গবন্ধুকে জানতে গেলে তো সব কিছুই জানতে হয়।“

রাজনৈতিক পট-পরির্তনে শিশু দিবস যেন বদলে না যায়, সে আহ্বানও জানান শিশু একাডেমির সাবেক এই কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “২০০১ সালে তখন বিএনপি ক্ষমতায়। জিয়া শিশু কিশোর সংগঠনের ৭ই নভেম্বরের একটি আলোচনায় আমি স্বাগত বক্তব্যে বলেছিলাম, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন সাংবাদিক ও ছড়াকার আবু সালেহ লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘না, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন’। আমি বললাম, জিয়া ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। এভাবে অনেকক্ষণ স্টেজে তর্কাতর্কি হয়।

“খালেদা জিয়া ও সেলিমা রহমান স্টেজে বসা। তখন সেলিমা রহমান খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘আপনি আনউইলিং হর্স নিয়ে শিশু একাডেমি চালাতে পারবেন না।’ তার দেড় মাস পর আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।”

আরেকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে গোলাম কিবরিয় বলেন, “বিএনপির আমলে একাডেমির এক জায়গায় লেখা ছিল, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তৎকালীন মন্ত্রী বদরুদ্দোজা চৌধুরী একদিন এসে আমার সাথেও দেখা করলেন না, এসে লিখে দিলেন, জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। পরে তারা ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর আমরা আবার বঙ্গবন্ধুর কথা লিখে দেই। এই বিষয়টা খুব ইস্টারেস্টিং। একবার বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা হয়, আর একবার লেখা হয়।”

সূত্র: বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম

আরও পড়ুন