বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্রের নামটি কেন রাসেল

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে ঢুকলেই আমি ছোট্ট তিনচাকার সাইকেলের কিড়িং কিড়িং বেলের শব্দে সচকিত হয়ে উঠি। আমি টের পাই, এইমাত্র আমাকে পাশ কাটিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে গেল ছোট্ট একটা সাইকেল।

বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ড বিশেষ করে শিশু রাসেলের মৃত্যু আমার মধ্যে এক আবেগঘন অভিঘাত তৈরি করেছিল। আর তাই ১৯৯৬ সালে আমার সম্পাদিত মাসিক ‘ছোটদের কাগজ’-এর অক্টোবর সংখ্যাটি আমি প্রকাশ করেছিলাম শেখ রাসেলকে বিষয় করে। প্রচ্ছদে রাসেলের একটা ছবি ছিল। শিরোনাম দিয়েছিলাম- ‘রাসেল হত্যার বিচার চাই’। টকটকে লাল রক্তের আবহে রাসেলের মিষ্টি একটা ছবি ব্যবহার করেছিলেন প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ।

রাসেল সংখ্যায় লিখেছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক-সাংবাদিকেরা। এবং লিখেছিলেন রাসেলের বড় বোন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও।

সেই সংখ্যায় আমার লেখাটি ছিল চিঠির আদলে। পরবর্তীতে সেই লেখাটায় আরো অনেক তথ্য-উপাত্ত সংযোজন করে রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ বই- শেখ রাসেলকে লেখা চিঠি। ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে বেরিয়েছিল বইটি। প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খানের মনকাড়া প্রচ্ছদে মোড়ানো বইটির কয়েকটি কপি নিজ খরচে আমার কানাডার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শিশু একাডেমির তৎকালীন পরিচালক প্রীতিভাজন মোশাররফ হোসেন। চিঠির আদলে লেখা সেই বইয়ে আমি লিখেছিলাম-

‘বন্ধু রাসেল,পৃথিবী বিখ্যাত একজন দার্শনিকের নাম রাসেল, বারট্রান্ড রাসেল। তোমার নামও রাসেল। আমরা তো জানি, তুমিও নিশ্চয়ই জেনেছিলে যে তোমার রাসেল নামটি রেখেছিলেন তোমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পৃথিবীতে এত নাম থাকতে তিনি তোমার নাম হিশেবে রাসেলকেই কেন বেছে নিলেন বলো তো? তোমার বড় দুই ভাইয়ের নাম ছিল কামাল এবং জামাল। সেই নাম দুটির সঙ্গে মিলিয়ে তোমার নামটি হতে পারতো আলাল-দুলাল কিংবা হেলাল-বেলাল টাইপের কিছু একটা। কিন্তু সেইদিকে না গিয়ে তোমার বাবা পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুস্কারপ্রাপ্ত বারট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তোমার নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল।

বারট্রান্ড রাসেল কেবলমাত্র একজন দার্শনিকই ছিলেন না। বিজ্ঞানী ছিলেন। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও। বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্যে বারট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন—কমিটি অব হানড্রেড। এই পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি নিরলস। তোমার জন্মের দু’বছর আগে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভের মধ্যে স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছিল। এক পর্যায়ে সেই স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধটি সত্যিকারের ভয়ংকর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন, বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল। মানবসভ্যতা বিধ্বংসী সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি থামাতে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল রাসেলের যুক্তির পক্ষে। কেনেডি-ক্রুশ্চেভ এক পর্যায়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তোমার রাসেল নামটা কেবলই সুন্দর বলেই রেখে দেয়া নয়। নামটি নির্বাচনের পেছনে তোমার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের নিশ্চয়ই মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা ছিল। বারট্রান্ড রাসেলের বই খুবই প্রিয় ছিল তোমার বাবার। জেলখানায় যাবার সময় তোমার মা যে স্যুটকেসটা গুছিয়ে দিতেন তোমার বাবাকে, সেই স্যুটকেসে প্রয়োজনীয় জামা-কাপড় এবং ওষুধ ও তামাক ছাড়াও বারট্রান্ড রাসেলের বইও দিয়ে দিতেন তিনি। তোমার বাবার প্রিয় লেখক ছিলেন বারট্রান্ড রাসেল। মুক্তিকামী নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের নেতা ছিলেন তোমার বাবা। তোমার রাসেল নামটিকে জড়িয়ে নিশ্চয়ই তার বড় কোনো স্বপ্ন ছিল। বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল। বড় কোনো প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা ছিল রাসেল।

বন্ধু রাসেল,তুমি জন্মেছিলে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে, ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে। তোমাদের বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িটি এখন বাঙালির শোকাচ্ছন্ন তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। একদা এই দেশটার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তোমার বাবা। আর এখন প্রধানমন্ত্রী তোমার হাসু আপা। তুমি বড় ভাগ্যবান রাসেল, তুমি বড় দুর্ভাগা।

তোমার হাসু আপা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তাকে বহুবার কাঁদতে দেখেছি রাসেল। বহুবার। তোমার কথা বলতে গেলেই কেঁদে ফেলেন তিনি। বড় কষ্ট হয় তখন আমাদের। যে কোনো শিশুসমাবেশে গেলেই, উচ্ছ্বল শিশুদের দেখলেই রাসেল রাসেল বলে কেঁদে ওঠেন তোমার হাসু আপা। ১৯৯৬ সালের ২৯ আগস্ট আমার সম্পাদিত ‘ছোটদের কাগজ’ পত্রিকাটির প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেবার সময় হাসিখুশি তোমার হাসু আপা সহসা তোমার কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে পড়েছিলেন। তার আকুল করা হৃদয় ভাঙা কান্না আমাদের বেদনার্ত করত রাসেল। কতটা অসহায় ছিলাম আমরা- একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী কেঁদে কেঁদে তার ছোট্ট ভাইয়ের হত্যার বিচার চাইছেন!

পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। এ শুধু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। তোমার বাবা শেখ মুজিব রাজনীতি করতেন। কিন্তু তুমি তো রাজনীতি করতে না! রাজনীতি করার মতো বয়সও তো ছিল না তোমার! তবে কেন তুমি গুলিবিদ্ধ হবে! কেন তোমার হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না! তুমি স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের ছেলে এটাই ছিল তোমার একমাত্র এবং সবচে বড় অপরাধ!’

পরিবারের কনিষ্ঠপুত্র হিশেবে মা-বাবা-ভাইয়া আর বোনেদের আদরের প্লাবনে ভাসতে ভাসতে বড় হতে থাকা রাসেল নামের ছোট্ট ছেলেটার জীবনের বর্ণালী শৈশবের নানা হাসি-আনন্দের অলিগলি পেরিয়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল ভয়ংকর রাত। ঘাতকদের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত জাতির পিতার পুরো পরিবারের সঙ্গে ছোট্ট শিশু রাসেলেরও রক্তাক্ত করুণ পরিণতি। জার্মানিতে অবস্থানের কারণে রাসেলের বড় দুই বোন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার বেঁচে যাওয়া। দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়ে অতঃপর শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া। এবং রাসেল হত্যার বিচার- এ সবকিছুই ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে বইটিতে, ইতিহাসের অংশ হয়ে। সেই হিশেবে বইটা গতানুগতিক জীবনীগ্রন্থ নয়। এটি একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ- একটি পরিবারের এবং একটি দুর্ভাগা দেশ ও দেশের ততধিক দুর্ভাগা জনগোষ্ঠীর।

বইটা শেষ করেছিলাম এ কথা বলে-

‘অনুজপ্রতীম বন্ধু রাসেল,আজ তোমাকে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখতে গিয়ে বারবার আমার কেবল মনে পড়ছে তোমার সাইকেলটির কথা। তিন চাকার বেবি সাইকেল। কিড়িং কিড়িং বেল বাজিয়ে ঘর বারান্দা উঠোন লবি চষে বেড়াতে তুমি। কোক পটেটো চিপস আর বর্ণালী টিকটিকির ডিম (স্মার্টি) ভীষণ পছন্দ ছিল তোমার। জানো রাসেল, আমার কন্যা নদীরও ছেলেবেলায় ভীষণ প্রিয় ছিল এই টিকটিকির ডিম। নদীর জন্যে নানান বর্ণের খুদে খুদে টিকটিকির ডিমের প্যাকেট কিনতে গিয়ে কতদিন যে তোমার কথা মনে পড়েছে আমার!

শুনেছি খুনিরা একে একে তোমাদের পরিবারের সবাইকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার পর সবার শেষে হত্যা করেছে তোমাকে। তুমি কাঁদছিলে। ‘‘মায়ের কাছে যাবো, মায়ের কাছে যাবো’’ বলে কাঁদছিলে তুমি। কাঁদবেই তো। তুমি তো বন্ধু মায়ের কাছেই যেতে চাইবে। মায়ের বুকের উষ্ণতা আর মায়ের গায়ের গন্ধই তো তোমার সবচে প্রিয় হবার কথা। খুনিরা সবাইকে শেষ করার পর তোমাকে পেয়েছিল। তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তোমার বাবার লাশ, মায়ের লাশ, ভাইদের লাশ অতিক্রম করে তুমি পৌঁছে গিয়েছিলে মায়ের লাশের কাছে। মায়ের লাশের পাশে তোমাকে দাঁড় করিয়ে তোমার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করেছিল মানুষরূপী একটা পশু। রক্তাক্ত তুমি কি লুটিয়ে পড়েছিলে মায়ের লাশের ওপর? শেষ মুহূর্তে কি তুমি মায়ের বুকের উষ্ণতাটুকু পেয়েছিলে বন্ধু? শেষ মুহূর্তে তোমার মায়ের গায়ের গন্ধ কি পেয়েছিলে তুমি?

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে ঢুকলেই আমি ছোট্ট তিনচাকার সাইকেলের কিড়িং কিড়িং বেলের শব্দে সচকিত হয়ে উঠি। আমি টের পাই, এইমাত্র আমাকে পাশ কাটিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে গেল ছোট্ট একটা সাইকেল। আর সাইকেলের চালকের আসনে ছোট্ট এইটুকুন একটা ছেলে। ছেলেটার পরনে একটা রক্তে ভেজা জামা। ছেলেটা কাঁদছে—‘‘আমি মায়ের কাছে যাবো। মায়ের কাছে যাবো…।’’

আহারে।’

লুৎফর রহমান রিটন ১৮ অক্টোবর ২০২০ লিংক

আরও পড়ুন