কোটি মুজিবের জন্মক্ষণ রক্তঝরা আগস্ট

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

যে মানুষটি শারীরিকভাবে উপস্থিত নেই; অথচ তাঁর নামে পরিচালিত হচ্ছে একটি জাতির মুক্তির সংগ্রাম বা স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাঁরই সম্মোহনী ডাকে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে হাসিমুখে, এসব দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে  বিরল। পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এমন মহান নেতাই বা ক’জন আছেন? তিনি জন্মেছিলেন বাংলা মায়ের কোলে। টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে। বাংলার কাদা জলে তাঁর বেড়ে উঠা। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বাঙালী জাতির ইতিহাসে এমনই একটি বেদনাবিধুর দিন যা কখনও ভুলবার নয়    । শ্রাবনের সেই রাতে আকাশে ভয়াল কালো মেঘের গর্জন হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি নয় ঝরেছিল রক্ত। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো বিশাল বুক থেকে রক্ত ঝরেছিল। রক্ত ঝরেছিল তাঁর পরিবারের প্রাণপ্রিয় সদস্যদের বুক থেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই রক্ত যেন রক্তজবার মতো ফুটে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এর কারণও ছিল বটে- তার রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিই ছিল ন্যায় ও সাম্য। দেশপ্রেম ও সরলতা ছিল তার চরিত্রের ভূষণ, নমনীয়তা, বিনয়, শিষ্টাচার ও চারিত্রিক দৃঢ়তা বঙ্গবন্ধুকে করেছে অসম্ভব জনপ্রিয়। জীবন- যাপনে বঙ্গবন্ধুকে অন্য দশজন সাধারণ বাঙালি থেকে আলাদা করা কঠিন ছিল। চলনে বলনে, পোশাকে পরিচ্ছদে, ভাবনায়-কল্পনায় তিনি ছিলেন একজন পুরোদ¯ুÍর বাঙালি। বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি তাকে কখনও আকর্ষণ করেনি। সুরম্য সুরক্ষিত বঙ্গভবন ছেড়ে তিনি নেমে এসেছিলেন বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির নিজস্ব বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পিছনে কাজ করেছিলো দুর্লভ চারিত্রিক দৃঢ়তা। শৈশব- কৈশর থেকে তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালী জাতিসত্ত্বার প্রতিষ্ঠা। তিনি অন্য কারোও সাহায্য নয় নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। অথচ আমরা দেখে কি অমুক ভাই তমুককে নেতা বানিয়েছে। অমুক তমুককে পোস্ট পাইয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ নিজগুণে নয় ভাইয়ের তোষামোদি করে নেতা। তাহলে ঐ নেতা পরবর্তীতে ভাইয়ের পা চাটা ছাড়া কোন উপায় আছে বলে তো আমার মনে হয়না।

অনেক নামে তাঁকে ডাকা হতো। বাংলার নয়নমনি ,বঙ্গশার্দুল, অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির মুক্তিদাতা। বিভিন্ন নামে ভূষিত করা হলেও অপূর্ন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের উপাধি। সে অপূর্ণতা পূরণ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। আর ঐতিহাসিক হয়ে গেল সেদিনের তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত গণসংবর্ধনা সমাবেশ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন উপাধিতে ভূষিত করার। ডাকসু ভিপি সেদিন গণমাধ্যমে বলেছিলেন “‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির অর্থ সে কি বিশাল! তিনিই বঙ্গবন্ধু যিনি ভালবাসেন, শুধু ভালবাসেননা; ভালবাসার জন্য আপোষহীন আমৃত্যু সংগ্রাম করেন। যার ভালবাসা নির্লোভ -নিঃস্বার্থ। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বন্ধু, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের বন্ধু সুতরাং তিনিই আমাদের  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”।আগুনে পুড়ে পুড়ে যেমন সোনা খাঁটি হয় তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামে পুড়ে পুড়ে ইস্পাত কঠিন হয়েছিলেন শেখ মুজিব।আমরা দেখতে পাই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়ও তিনি সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। দক্ষ সংগঠক ও তরুন নেতা হিসেবে খ্যাত শেখ মুজিব তাঁর চেয়ে বয়সে প্রবীন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অগ্রসর কিংবা জেল জুলুম খাটা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া সব নেতাকে ছাপিয়ে  পূর্ব বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকে কেবল ইতিহাসের পটে রেখে স্মরণ  করলে তাঁকে আংশিক পাওয়া যাবে। তাঁকে পাওয়া ও বোঝা পূর্ণতা পাবে একই সংগে তাঁর অর্জন ও অবদানকে বর্তমান  প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ণ করলে। ইতিহাস চলে তার আপন গতিতে। সময় নির্ধারণ করে দেয় ইতিহাসের গতিপ্রবাহ। তবে পৃথিবীতে কিছু মহা মানব তাঁদের কর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে সেই সময়কে দেয় নতুন মাত্রা। তাঁরা নির্মান করেন সমাজ, সংস্কৃতি আর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। স্থান কালের সীমানা পেরিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মমান্তরে তাঁরা থাকেন আমাদের কোটি কোটি হৃদয়ের অন্ত:স্থলে অনুপ্রেরণা আর ভরসার সৌম্যহনী শক্তি হিসেবে।

১৫ ই আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম হত্যাকা-ের সাক্ষী। অনেকে বলেন এটি নিছক হত্যাকান্ড ছিল। কিছু মানুষ বঙ্গবন্ধুর উপর ক্ষুব্দ হয়ে উঠেছিল সেই ক্ষোপের বিস্ফোরণ হত্যাকা-। এই ব্যাখ্যা ভুল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে যার রূপায়ণ ঘটেছে বিপথগামী একদল সেনা অফিসারদের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করাছিল সেই আদর্শকে সমূলে বিনাশ করা। কিন্তু নির্বোধ আর মূর্খের দুঃসাহস বরাবরই বেশি থাকে। মূর্খতা ও মূঢ়তার বশবর্তী হয়েই খুনীরা সেদিন বাঙালিদের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার এক দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। এ কূপম-ুকতার কি কোন জবাব আছে! বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধুর মর্মস্পর্শী মৃত্যু, এ যেনো কোটি হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর নতুনকরে দ্বিগুণ শক্তিতে জেগে উঠা। তার সাহিত্যের ভাষার সরল অর্থ এই যে,  একি সম্ভব যে, জোনাকি পোকা চাঁদের দ্যুতি হরণ করে নেবে? সিংহের বিক্রমে বনে দাপিয়ে বেড়াবে ছাগল? মেঘও কদাচিৎ সূর্যের মুখ ঢেকে দিতে পারে বটে তবে তা সাময়িক। কিন্তু সূর্য্য পুরো দিবসের। তাকে ঢেকে রাখার যত অপচেষ্টাই করা হোক না কেন তা আপন রূপে উদ্ভাসিত হবেই। বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো। তাঁকে ঢেকে রাখার বা অস্বীকার করার সাধ্য কারোও নেই। কিন্তু মূর্খদের তো তা জানার কথা নয়।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই হৃদয়বিদারক সংবাদটি শোনার পর তাৎক্ষনিকভাবে সাহিত্যিক- সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিন তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন; মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হবেন। দ্যা টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ ই আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় “সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের  বাস্তব কোনও অস্তিত্ব নেই। তাদের এ ভবিষ্যদ্বানীর আমোঘতা প্রত্যক্ষ করার জন্য জাতিকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। জাতির বিবেকই সেদিন কথা বলে উঠেছিল। কেঁদে উঠেছিল মুজিবময় লক্ষ কোটি হৃদয়। আর তা যথারীতি মূর্ত হয়ে উঠেছিল কবি -সাহিত্যিক- শিল্পীদের লেখায়, রেখায় ও তুলিতে। বাদ যায়নি রাখালের বাঁশি কিংবা বাউলের একতারাও। সাধারণ মানুষের কোটি হৃদয়ের জমিনে অতি সযতনে মুজিব হত্যার শোক মুজিব আদর্শের দানা বেঁধে পরিনত হয়েছিল এক একটি বীজে। সেই প্রতিটি বীজে শিশু মুজিব ভ্রূণ হয়ে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়েছিলো কোটি বাঙালির হৃদয়ে আর অপেক্ষায় ছিলো অনুকূল পরিবেশে অঙ্কুরোদগমের। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকার প্রধান । সমগ্র বাংলায় মুজিব চর্চার অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। এই অনুকূল পরিবেশে মুজিব আদর্শের সেই ভ্রূণ অঙ্কুরিত হয়ে পত্র-পল্লবে, ফুলে-ফলে সু-শোভিত হয়ে সমগ্র বাংলায় বিস্তৃতি লাভ করবে। একদিন মুজিব আদর্শের এই সু-শোভিত বৃক্ষগুলো শাখা -প্রশাখা বিস্তার করে মহীরূহে পরিনত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় ছায়া দান করবে আর ছড়িয়ে দিবে মুজিব আদর্শের নব নব সম্ভাবনা। এই বিশ্বাসই হোক আমাদের শোককে শক্তিতে রূপান্তরের শপথ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, দেশীয় ও বৈশ্বিক ভাবনার ক্ষেত্রে আমরা ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি দিনকেদিন। সে কারণেই সৃষ্টি হয়নি নতুন করে বড় কোন ধরণের তরুন বুদ্ধিজীবী সমাজ। এই আত্মকেন্দ্রিকতার কারণেই আমরা লক্ষচ্যুত হয়ে পড়েছি শোককে শক্তিতে রূপান্তরের শপথ থেকে।

তাই জাতীয় শোক দিবসের এই দিনে আসুন কণ্ঠস্বর তুলি- আর নয় সুপ্ততা! এবার জেগে উঠি মুজিব আদর্শে উদ্দীপ্ত কোটি প্রাণ। এইতো সঠিক সময় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার পিতার আদর্শের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মননে ও কর্মে। যে বাংলায় থাকবেনা কোন সাম্প্রদায়িকতা,ধর্মান্ধতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, জঙ্গিবাদ, ভোগসর্বস্বতা, মাদক ও নেশার করাল গ্রাস। বঙ্গবন্ধু এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে চির ভাস্বর, চির অম্লান হয়ে আছেন,থাকবেন অপার ভালবাসা ও শ্রদ্ধায়। মুজিব আদর্শ ছড়িয়ে পড়বে কোটি হৃদয় থেকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এভাবেই প্রতিবছর রক্তঝরা আগস্ট আসবে বাংলার ইতিহাসে দেশ গড়ার সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে কোটি মুজিবের জন্মক্ষণ রূপে।

 

মোসা. সেলিনা আকতার ১৫ আগস্ট ২০২০ লিংক

আরও পড়ুন