ধর্মনিরপেক্ষতা ও বঙ্গবন্ধু একটি রাষ্ট্রদার্শনিক বিশ্লেষণ

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

সেক্যুলারিজম (Secularism) কে বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতা কিংবা নাগরিক রাষ্ট্রবাদ নামে অভিহিত করা যায়। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সমার্থক ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটিও ব্যবহার করা যায়। সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার বিভিন্ন রূপ রয়েছে, যাকে বিভিন্ন মতালম্বীরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এজন্য এর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অনেক।

আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তায় প্রাচীন যুগে নৈতিকতা এবং মধ্যযুগে ধর্ম ছিল মূল ভিত্তি। মূলত রেনেসাঁ বা নবজাগরণ এবং সংস্কার আলনের ফলশ্রুতিতে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলা হয়। তিনি রাষ্ট্রকে সবকিছুর উপরে স্থান দিয়ে রাষ্ট্রচিন্তার জগতে মুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছেন।

ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করার কথা বলেছেন। তার কাছে ‘রাষ্ট্রের যুক্তিই’ হচ্ছে বড় যুক্তি এবং রাষ্ট্র একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ছিল তার নিকট একটি বাস্তব সত্য এবং ধর্ম ছিল আধ্যাত্মিক ব্যাপার। ম্যাকিয়াভেলির এ দৃষ্টিভঙ্গিই সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রায়িক রাষ্ট্রচিন্তার সূত্রপাত ঘটায়। এই সেক্যুলারিজম সৃষ্টিতে দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবি হবস, লক, স্টুয়ার্ড মিল, অগাস্ট কোৎ, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের প্রভাবেই পাশ্চাতে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ লেখক Holyoake সর্বপ্রথম ‘Secularism’ শব্দটি প্রবর্তন করেন ১৮৫১ সালে ‘The Reasoner’ পত্রিকায়।

সেক্যুলারিজম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “Secularism is an orientation to life that places paramount important on the matters of ‘this world’, and considers observation and reason the best means by which the things of this world can be known and improved”.২ সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মকথা হচ্ছে পার্থিব সর্ব বিষয়ে ঐহিকতাবাদ। একটি রাষ্ট্রে নানা জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা পেশা-সংস্কৃতি ও জগৎ ভাবনার লোক বাস করে। রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকমাত্রকেই মানুষ কিংবা ব্যক্তি মানুষ মাত্রকেই শুধু নাগরিক বলে স্বীকৃতিান এবং বাস্তব জীবনের প্রয়োজন মেটানো৩। রাষ্ট্রের নাগরিকদের যার যার ধর্ম তার তার, রাষ্ট্র ব্যক্তির ধর্ম পালনে বাঁধা দিবে না, আবার উৎসাহও যে দিবে তাও নয়, রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে উদাসীন থাকবে। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান চোখে দেখবে, ধর্মকে কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না, রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক থাকবে’- এ নীতিদর্শনে বিশ্বাসকেই ধর্মনিরপেক্ষতা বলা যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫), যার নেতৃত্বে পাকিস্তানি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভাষা, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা উন্মেষ ঘটেছিল এবং বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের নির্দিষ্ট পরিসীমায় (বাংলাদেশ) সার্বভৌমত্ব লাভ করেছিল। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতির র্শন ছিল মানবপ্রেম। তিনি ছিলেন অসাম্প্রায়িক, যাঁর কাছে মানবীয় মূল্যবোধই ছিল মুখ্য। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তে তিনি বলেন, “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙ্গালি হিসাবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে”৪। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনার মর্মমূলে ছিল মানবতার দর্শন। তিনি ছিলেন নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের শেষ ঠিকানা। সেজন্য তাঁর কাছে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানবধর্মই প্রধান ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক র্শন বিশ্লেষণ করলে বাঙালি জাতীয়তাবা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র তথা বৈষম্যহীন সমাজ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো এই মৌলিক প্রত্যয়সমূহ পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বলেন: “ বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না।

রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা”। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মূল সংবিধানে চারটি মূলনীতি গ্রহণ করেছেন- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ভিত্তি রাষ্ট্র পরিচালনার এই চারটি মূলনীতি। শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রদর্শনের মূল উপপাদ্য বিষয় এই চারটি মূলনীতি। চারটি মৌলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালি জাতিসত্তার পরিচিতি, গণতন্ত্র ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র আর সামাজিক মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।

সংবিধানের স্তম্ভ চারটি একটি অন্যের পরিপূরক। বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, লোকাচার, সাংস্কৃতিক র্শন হাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাসে সমৃদ্ধ। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-সকল সম্প্রদায়ের মানুষের আত্ম-পরিচয় সম্বন্ধে সম্মিলিত অনুভূতি বা চেতনার নামই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ চেতনা ধর্মভিত্তিক বা সাম্প্রদায়িক নয়; এটি অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। যার প্রধান উৎস আবহমানকালের অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ৫। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল অসম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আবার গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

মূলত অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিকাশের মাধ্যমে বাংলার গণমানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে, সম্পদের সুষম বন্টন প্রক্রিয়ায় বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের সাথে সামজ্ঞস্য রেখেই সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানার মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং একটি আদর্শ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতি একটি অপরটির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং যা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূল বিষয়বস্তু।

বেল্লাল আহমেদ ভূঞা, লেখক-প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Link: OdhikarNews | ০৯ আগস্ট ২০১৯, ১৬:১৮

আরও পড়ুন