বাংলাদেশের উন্নয়ন- ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াবার এক বিস্ময়কর গল্প

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সংগ্রামী মানুষগুলোর মনে স্বপ্নের এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচার সেই আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে। রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি পর্বে সাম্যের অর্থনীতি ও সমাজ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার স্থান পেয়েছে তাতে। সেই অঙ্গীকারের আলোকেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত এক অর্থনীতিতে পুনর্নির্মাণে নেমে পড়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সুযোগ্য সহনেতারা। এক ডলারের রিজার্ভ ছিল না কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। তবুও সাহসী নেতৃত্বের কারণে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য করে বলে দিলেন বাংলাদেশ এক ‘আন্তর্জাতিক তরাবিহীন ঝুড়ি’। এত মানুষ, সামান্য সম্পদ, প্রকৃতি বিরূপ। তাই এ দেশের কোনো সম্ভাবনা নেই। মালথুসিয়ান তত্ত্বের পুরো রূপায়ণ ঘটবে বাংলাদেশে! বাংলাদেশের পড়শী দেশগুলোতে বরং অর্থনৈতিক শরণার্থীদের চাপ পড়বে। এর কয়েক বছর পর, বিশ্ব ব্যাংকের দুই অর্থনীতিবিদ ইউস্ট ফাল্যান্ড এবং জন পার্কিনসন এক বইয়ের শিরোনাম করলেন ‘বাংলাদেশ : অ্যা টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’। ভাবখানা বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারলে পৃথিবীর যে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে। চ্যালেঞ্জিং প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে দারুণ সাফল্য দেখিয়ে ছিল। স্থলপথ, রেলপথ ও জলপথ ফের সচল হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বাড়তি, খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি, কোটি মানুষের পুনর্বাসন, তরুণদের গগনস্পর্শী স্বপ্ন পূরণের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সরকার জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছিল। সংবিধান রচনা ছাড়াও নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলানোর ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ ব্যাপক হারে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁর ডাকে।

ভঙ্গুর দেশটি যখন দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল ঠিক তখনি আচমকা আক্রমণের শিকার হলো। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট দেশবাসী হারালো বঙ্গবন্ধুকে এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে। স্বদেশ চললো উল্টোপথে। অনেক চড়াই-উৎরাই শেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত তাঁর পাঁচ বছরের দেশ পরিচালনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শুভযাত্রা লক্ষ্য করার মতো। ফের ছন্দ-পতন। দীর্ঘ আট বছর পর ২০০৯ সালে তিনি ফের বাংলাদেশ পরিচালনার সুযোগ পেলেন। এরপর আর বাংলাদেশকে পেছনে তাকাতে হয়নি। এই নয় বছরের উন্নয়ন অভিযাত্রা সত্যি বিস্ময়কর। এক নাগাড়ে নয় বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়ে তিনি দীর্ঘমেয়াদি অনেক বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এসবের সুফল দেশের মানুষ এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজে যুক্ত থাকার। ‘দিন বদলের সনদ’ শিরনামের ঐ ইশতেহারটিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি উন্নয়নের ভবিষ্যৎ রূপরেখা (ভিশন-২০২১) নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ঐ ইশতেহারে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল সেগুলোর কয়েকটি উল্লেখ করছি। সংশ্লিষ্ট বাধাগুলো দূর করে সর্ব্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অঙ্গীকার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি মোকাবেলা, অবকাঠামো উন্নয়ন, উপজেলা ও গ্রাম পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তির প্রসার, বন্দর উন্নয়ন, সড়ক, রেল ও নৌযোগাযোগের প্রসার, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ঘটিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালুর অঙ্গীকার করা হয় ঐ ইশতেহারে। এ ছাড়াও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে মানব-সম্পদের উন্নয়ন করে কর্মসংস্থান বাড়ানো, দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন, কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে তার প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, সামাজিক সংরক্ষণমূলক কর্মসূচির প্রসার, চর, হাওর ও উপক‚লে দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারগুলোকে শক্তিশালী করা, আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপ্তি বাড়ানোর মতো লক্ষ্যধর্মী সব অঙ্গীকার করা হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দিনবদলের ঐসব অঙ্গীকার নিরন্তর পূরণ করে যাচ্ছে। এই নয় বছরে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সূচকসমূহের যে বিস্ময়কর অর্জন ঘটেছে তা খালি চোখেও দেখা যায়। তবু পরিসংখ্যান দিয়ে বিগত নয় বছরের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কিছু সূচকের অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরছি।

এক. জিডিপির প্রবৃদ্ধি : ২০০৭-০৮ অর্থবছরের জিডিপির (অর্থনীতির আকার) পরিমাণ ছিল চলতি মূল্যে ৬,২৮,৬৪২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯,৭৫,৮২০ কোটি টাকায়। এ নয় বছরে অর্থনীতির আকার বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও পাঁচ-ছয় শতাংশের গণ্ডি পেরিয়ে গত দুবছর ধরে সাত শতাংশের বেশি হচ্ছে। গত অর্থবছরে তা বেড়েছে ৭.২৮ শতাংশ হারে।

দুই. মাথাপিছু আয় : একদিকে জিডিপির আকার বেড়েছে অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও ক্রমান্বয়ে কমেছে। ফলে, মাথাপিছ্ ুআয় দ্রুত বাড়ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছর শেষে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৪৩,৭১৯ টাকা। আর তা এই নয় বছরে বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। গত অর্র্থবছর শেষে তা ছিল ১,২২,১৫২ টাকা। আর মূল্যস্ফীতি পাঁচ-ছয় শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল ছিল বলে মানুষের প্রকৃত আয় বেড়েছে।

তিন. দারিদ্র্য নিরসন : মাথাপিছু আয় বাড়লে দারিদ্র্য কমে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের আয় রোজগার কৃষি ছাড়াও অকৃষি খাত থেকেও বেড়েছে। গ্রামের তরুণরা নগরে ও বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের আয় রোজগার করে গ্রামে পাঠাচ্ছে। তাই গ্রামীণ শ্রমবাজার বেশ ‘টাইট’। সেজন্য গ্রামীণ মজুরিও বেড়ে চলেছে। তাই সারাদেশেই দারিদ্র্য কমছে। অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে। তবুও বিরাট সংখ্যক মানুষ অতিদরিদ্রই রয়ে গেছে। তাদের জন্য সরকার নানা ভাতা দিচ্ছেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর সংস্কার করে সমুন্নত করা হয়েছে।

২০০৭ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪০ শতাংশ সেখানে ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৩ শতাংশে। গ্রামীণ দারিদ্র্য ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৪৩.৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা হয়েছে ২৬.৪ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হারও দ্রুতই কমছে। ২০০৫ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ২৫.১ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা ১২.৯ শতাংশ হয়েছে।

চার. গড় আয়ু : দারিদ্র্য কমেছে এবং সামাজিক সংরক্ষণ বাড়ার কারণে গত নয় বছরে গড় আয়ুও বেড়েছে। ২০০৭ সালে প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল ছিল ৬৪.৫ বছর। ২০১৭ সালের শেষে তা ৭২ বছরে দাঁড়িয়েছে।

পাঁচ. আমদানি-রপ্তানি : এই নয় বছরে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রপ্তানির জন্যে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি অপরিহার্য। তাছাড়া বেশ কিছু ভোগ্য পণ্যও আমাদের আমদানি করতে হয়। গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে আমাদের আমদানির পরিমাণ ছিল ১,৩৩,৬৫০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩,৪৯,১০০ কোটি টাকা। তার মানে আমদানি বেড়েছে ৩৩ গুণ। অন্যদিকে রপ্তানি ঐ সময়ের ব্যবধানে বেড়েছে পঁয়ত্রিশ গুণ।

ছয়. রেমিটেন্স : ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় রেমিটেন্স প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঐ সময়ে ৫৪২ বিলিয়ন টাকা থেকে বেড়ে ১০১১ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণসহ সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাংকগুলোকে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলার অনুমতি দিয়েছে। টাকার বিনিময় মূল্যও স্থিতিশীল ছিল। তাই রেমিটেন্স দ্রুত বেড়েছে। রেমিটেন্স বাড়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাহিদাও বেড়েছে। তাই গ্রামীণ ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। আর দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহযোগিতায় মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং এর প্রচলন হওয়ায় দ্রুত রেমিটেন্সের লেন দেন হচ্ছে। গ্রামে ব্যাংকের শাখাও এই নয় বছরে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ফলে গ্রামে বসেই মানুষ আধুনিক ব্যাংকিং সেবাও পাচ্ছেন। গ্রাম-বাংলার অর্থনীতির এই অগ্রগতি সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সাত. রিজার্ভ : রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়ায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এই নয় বছরে বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। ২০১৭ শেষে তা ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০৭-০৮ সালে ছিল ছয় বিলিয়ন ডলারের মতো।

আট. সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ : গত নয় বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিযোগের পরিমাণও তিনগুণেরও বেশি হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরে তা আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এফডিআই ছিল ৭৬৮ মিলিয়ন ডলার। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলারের মতো। প্রস্তাবিত শতাধিক বিশেষ অর্র্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ বাস্তবায়িত হলে এর পরিমাণ আরো দ্রুত গতিতে বাড়বে।

নয়. বাজেট : ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মোট বাজেট ছিল ৮৭,১৮৭ কোটি টাকা। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪,০০,২৬৬ কোটি টাকায়। এ ক’বছরে বাজেটের আকার পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দশ. অবকাঠামো উন্নয়ন : বাংলাদেশ সরকার এই নয় বছরে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য অসংখ্য উদ্যোগ ছাড়াও দশটি মেগা প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই দশটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই মেগাপ্রকল্পগুলো হলো : সেতু বিভাগ-এর পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ, রেলপথ মন্ত্রণালয়-এর (১) পদ্মা রেল সেতু সংযোগ ও (২) দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে গুনদুম পর্যন্ত নির্মাণ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ-এর ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (এমআরটি), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের (১) পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প (১ম পর্যায়) ও (২) সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বিদ্যুৎ বিভাগের (১) মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোলফায়ার্ড পাওয়ার ও (২) মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার (রামপাল), জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ-এর এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-এর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন।

এগারো. জ্বালানি : জ্বালানি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ২০০৮ সালে ৪৫% মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ যেত। ২০১৫ সালে তা ৭৪% মানুষের ঘরে পৌঁছায়। এই দুবছরে বিদ্যুৎ প্রাপ্তির হারও আরো বেড়ে তা আশি শতাংশেরও বেশি মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে।

বারো. ব্যাংকিং খাত : নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল ও ঝুঁকিসহনে সক্ষম অবস্থানে রয়েছে। তবে, খেলাপি ঋণের হার কিছুটা অস্বস্তিকর পর্যায়ে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রয়োগের কারণেও এ হার খানিকটা স্ফীত হয়েছে।

ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে। গত আট বছর নয় মাসে ব্যাংকিং খাতের মূলধনে ৩৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন। তবে সরকারি ব্যাংকের জন্য তা সত্যি নয়। ব্যাংকসমূহের সংরক্ষিত মূলধন ২০০৮ এর ২০,৫৭৮ কোটি টাকা থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৭ এ ৯০,১০১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ মূলধন পর্যাপ্ততার হার ব্যাংকসমূহের হার ব্যাংকসমূহের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০.৬৫ শতাংশ।

জুন ২০০৯ শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ২,৭৮,৬৮০ কোটি টাকা, যা আট বছরের ব্যবধানে জুন ২০১৭ শেষে ২১৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৭৭,৮৮৩ কোটি টাকা।

এ ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের আওতায় নয় বছরে তিন হাজারের বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নতুন শাখা খোলা হয়েছে। দশ টাকার হিসেব সংখ্যা এই ক’বছরে ১ কোটি ৭২ লাখে উন্নীত হয়েছে। এর সাথে তের লাখ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব, ১৩ লাখ এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব ও ৫ কোটি ৭৮ লাখ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব যুক্ত করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবাখাতে যে বিপ্লব ঘটেছে তার আন্দাজ পাওয়া যায়।

কৃষি ঋণ, সবুজ ঋণ ও এসএমই ঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।

এ ছাড়াও দশটি নতুন ব্যাংক এই নয় বছরে চালু হয়েছে। তবে ফার্মার্সসহ দু’একটি ব্যাংকের অনিয়মের কারণে ব্যাংকিং খাতে খানিকটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো শক্ত হাতে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করবে এবং গ্রাহকের আস্থা অটুট রাখবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নয় বছরে বিস্ময়কর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বড় বড় প্রকল্পগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত সময়ে বাস্তবায়ন হলে, দেশের এই চলমান উন্নয়নের ধারা এক নতুন মাত্রা পাবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে তা পূরণ করা সহজতর হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণে যে সাহস বাংলাদেশ দেখিয়েছে তা সারা বিশ্বেই স্ব-উন্নয়নের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিষ্ঠ হয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। দেশপ্রেমও যে উন্নয়নের এক আদর্শ উপকরণ- পদ্মা সেতুর এই অসাধারণ গল্প যুগে যুগে বাংলাদেশের মানুষকে তা মনে করিয়ে দেবে। সবশেষে বলতে ভালো লাগছে যে মাত্র আট বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গত চার দশকের একটু বেশি সময়ের ব্যবধানে ২৫৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। চোখ ধাঁধানো এই রূপান্তরের ফসল হিসেবে বাংলাদেশ অচিরেই স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয়ের খোলস ছেড়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মবিকাশ করবে। তবে নতুন এই পরিচয় এক দিকে যেমন আমাদের আত্মশক্তির ভিত্তিকে মজবুত করবে অন্যদিকে অনেক চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করার সাহস জোগাবে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানি বাণিজ্যে আমরা ইউরোপ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধে পেয়ে আসছি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ সুযোগ সীমিত হয়ে আসবে। তবে আমরা যদি আমাদের উৎপাদনে দক্ষতা বাড়াতে পারি, গুণমানের শিক্ষা নিশ্চিত করে উপযুক্ত জনশক্তি তৈরির কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে যেতে পারি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত ভৌত কাঠামো ও রাজস্ব ও বিনিয়োগ নীতিকে সহজ করতে পারি তাহলে নয়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকেই বাংলাদেশ জোর কদমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। সেজন্য, আমাদের রপ্তানির ভিত্তি সম্প্রসারণ করতে হবে।

বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। স্বল্প মেয়াদের চেয়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোক্তাদের ওপর ভরসা রাখতে হবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধে নিশ্চিত করতে হবে। এ বছরই বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলে এশিয়ার অন্যতম অগ্রগামী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। চীনের পরেই বাংলাদেশের নাম এক্ষেত্রে উচ্চারিত হয়েছে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাহাত্তরে আটশ কোটি টাকার বাজেটের বাংলাদেশ এতোটা সফল হবে তা কি কেউ ভেবেছিল সেই সময়? কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্ত‚প থেকে উচ্চ সম্পদশালী এক দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের এই বিজয় গাঁথা বিশ্ববিখ্যাত অর্থনৈতিক সাময়িকী ‘ইকোনমিস্টে’র চোখ এড়ায়নি। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয় বেশি হবার খবরটি দেবার সময় ওই সাময়িকী বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের কথা বেশ জোর দিয়েই বলেছে। আসুন আমরা দ্রুত অগ্রসরমান এই বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে নিষ্কণ্টক করি। নির্ভার করি।

 

ড. আতিউর রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ লিংক

আরও পড়ুন