… ‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ একটি প্রজন্মের যখন জাগরণ হয়, তখন সে জাগরণের জোয়ারে সবরকম অপশক্তি পরাজিত হতে বাধ্য। একটি জাতির তরুণ সমাজ যখন জেগে উঠতে জানে, তখন সেই জাতিকে দমাতে পারে এমন শক্তি নেই। বাঙালি এমন একটা জাতি যে জাতির জন্ম বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা, বাংলাদেশ নামক ছোট্ট সবুজ দেশটি রক্তের দামে কেনা, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করে নেয়া, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের দামে, দুই লাখ বীরাঙ্গনা মায়ের সম্ভ্রমের দামে কেনা এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। আর, বাঙালির এই উত্থানপর্বে, বাঙালি জাতির নিজস্ব স্বকীয়তা নির্মাণে, বাঙালির শেকড় সন্ধানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪১। ডিজিটাল বাংলাদেশ। মধ্য আয়ের বাংলাদেশ; শব্দগুলো এখন প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয়। মনের গহিনে ডেকে যায় আনন্দের বান। শব্দগুলো এমনি এমনি রাজনৈতিক বক্তৃতার রাশিমালায় গ্রোথিত হয়নি। পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া যুক্ত হয়নি সরকারি প্রেসনোটে, কিংবা উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাবনায়। শব্দগুলোর মূল ভিত্তি রচিত হয়েছিল, একাত্তরে, বা তারও আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে। সেই সময়ে রোপিত বীজের পরিষ্ফুটন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, সংশোধন আর পরিচর্যার পরে আজকের অবস্থান। মধ্য আয় বলি, ডিজিটাল বলি, অথবা জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যপূরণই বলি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অস্তিত্বের স্বপ্নের পুরোধা, প্রবাদপুরুষ। তিনি বাঙালির স্বপ্নের মানব। তিনি খোকাবাবু থেকে কখনো হয়ে উঠেছেন মহাপুরুষ, কারো কাছে তিনি মহামানব, কেউ ডেকেছেন মহাপ্রাণ নামে, কারো কাছে মনে হয়েছে তিনি কিংবদন্তির জীবন্ত নায়ক, কেউ চিনেছেন তাঁকে দানবীর হিসেবে। সর্বশেষ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন। এসবের কোনো নামই মিথ্যে নয়। এর পেছনে বড় কারণ আছে। সেটা হলো এই যে, আমাদের এই হতভাগ্য সমাজের উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা খুব অল্প। বেশিরভাগেরই সামর্থ্য থাকে না, যাদের থাকে তারা স্বার্থবিমগ্ন ও আত্মসুখপরায়ণ হয়। তারা দানদক্ষিণা বা সমাজ ও মানুষের উন্নয়নের ধার ধারে না। সেই সঙ্গে খ্যাতির বিড়ম্বনায় হয়তো কিছু মানুষ সমাজের উন্নয়নে অল্পস্বল্প অবদান রাখার চেষ্টা করেন, তবে সেটা বিরক্তিতে, কেউ করেন বাধ্য হয়ে, কেউবা অদৃশ্য কোনো মতলবে। বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান কোনো বিনিময় ছাড়াই, সামনে-পিছনে না তাকিয়ে কেবল মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। বঙ্গবন্ধুর এই অসামান্য হয়ে ওঠার একটা কারণও আছে, তা হলো এই যে, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই ভীরু, বীরের সংখ্যা অতি অল্প। তাই যে কোনো ক্ষেত্রে হোক বীরত্ব যিনি দেখান, সাহস করেন, এগিয়ে যান; তাঁর প্রতি ভেতর থেকেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভক্তি জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে।
ছাত্ররাজনীতি সক্রিয় থেকেই বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি, নিজস্ব পরিচয় ছাড়া বাঙালি জাতির উন্নতি হবে না কখনোই। সে সময়েই তিনি হৃদয়ে ধারণ করেন বাঙালি জাতির মুক্তির দৃঢ় আভা। বহিঃশক্তির শোষণ-পীড়ন ও আধিপত্য মেনে নিয়েই বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। অনুগত জীবনব্যবস্থার নির্মম বাস্তবতাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল এ জনপদে। শাসকগোষ্ঠীর নিত্য কৌশলে খাপ-খাইয়ে নিয়ে দিন প্রবাহেই তুষ্টি ছিল বাঙালি জাতি। তাদের ভাবনায় স্বাধীনতা প্রসঙ্গটি অনুপস্থিত থেকেছে সবসময়। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীন করার প্রচেষ্টা থাকলেও বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি তাতে স্থান পায়নি। তবে অনুগত জীবনের মেয়াদও তো আর চিরস্থায়ী হতে পারে না। মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বর্গসুখের ভাবনাটি স্থান পেয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনায়। তাই তো বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাঙালি আজ একটি গর্বিত জাতি। বিশ্ব দরবারে পতপত শব্দে উড্ডীয়মান লাল সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অস্তিত্বের স্বপ্নের পুরোধা, প্রবাদপুরুষ। তিনি বাঙালির স্বপ্নের মানব।
নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে তিনি এগিয়ে গেছেন সর্বদা। রাতের অজস্র প্রহর আর দিনের রৌদ্রছায়ার হাজারো ক্ষণ তাঁর অতিবাহিত হয়েছে কারাগারে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো, যৌবন ও তারুণ্যের মূল্যবান সময়গুলো তাঁকে কাটাতে হয়েছে কারাবন্দি হিসেবেই। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বারবার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনো আপস করেননি। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেননি। তাঁর জীবনে জনগণই ছিল অন্তঃপ্রাণ। মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। বাঙালি জাতিকে বীর হিসেবে বিশ্বে দিয়েছেন অনন্য মর্যাদা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে বিশ্বে এক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন সফল করেছেন। বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন জাতীয় পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন নিশ্চিত করেছিলেন, তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেট তাঁকে জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। স্বাধীন বাংলার মাটি তাঁর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বাঙালি জাতির ললাটে চিরদিনের জন্য কলঙ্কের টিকা এঁকে দিয়েছে খুনিরা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগ্রামের ইতিহাস সভ্য পৃথিবীতে সর্বজনবিদিত। রক্তের দামে কেনা এ দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও প্রগতি প্রতিটি নাগরিকের অঙ্গীকার। তাই উন্নয়নের পথে ধাবমান বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সূচক প্রতিদিনই বাড়ছে। নানা অসঙ্গতি, অপচয়, অনিয়ম সত্ত্বেও অগ্রগতির সড়কে এখন বাংলাদেশ প্রায় অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসরমান। সরকারের সঙ্গে জনগণের আকাক্সক্ষার কাছে সম্পর্ক এর পেছনে জোগাচ্ছে শক্তি। দূরদর্শী সরকারের গতিশীল নেতৃত্বে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে সব কার্যক্রম। কিন্তু দেশপ্রেমিক জনসাধারণের লালিত স্বপ্ন পূরণের সে অভিযাত্রায় কায়েমি স্বার্থবাদীশ্রেণি সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করছে প্রতিবন্ধকতা। অপরদিকে একাত্তরের পরাজিত শক্তি আগের তুলনায় এখন আরো বেশি সক্রিয় ও শক্তিমান, কুশলী। বিশেষ একটি মহল দেশকে অন্ধকারের চোরাগলিতে নিমজ্জিত করতে এখনো তৎপর। নানা ইস্যুতেই দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া তারা। কিন্তু সেসব বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সহস্র প্রতিক‚লতা কাটিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে অবিচল নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে যে কোনো প্রতিক‚লতা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে তিনি অনড়। সে জন্যই সম্ভব হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি বিশাল পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন। অন্য সবার কাছে যা অসম্ভব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা অনায়াস সাধ্য- এটাই শেখ হাসিনা নামের মানবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতম দিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপে আজ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গত ৪৬ বছরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের রোলমডেল।
পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এ ব্যবধান আরো বেড়ে যায়। এ অঞ্চলের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সে অবস্থার পরিবর্তন করেছে অনেক আগেই। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়েছে। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর। বাংলাদেশের চেয়ে ২ বছর বেশি ছিল তাদের গড় আয়ু। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর, যা পাকিস্তানের চেয়ে ৬ বছর বেশি। জাতিসংঘের সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ১৮৮ দেশের মধ্যে ১৩৯তম। পাকিস্তান পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে ৮ ধাপ। ৫ বছরের কম শিশু মৃত্যুহারেও এক সময় বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের পর প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানে এ সংখ্যা ৭৯ জন। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার এক সময় অনেক বেশি ছিল। এ ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এ হার ৭২ শতাংশ।
গত সেপ্টেম্বরে দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন পাকিস্তানের তুলনায় এ দেশ অনেক দরিদ্র ছিল। জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ আসত শিল্প খাত থেকে। ৪৬ বছরের মাথায় বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ১৫৩৮ ডলার, পাকিস্তানে যা ১৪৭০ ডলার।
স্বাধীনতার পর মানুষের মুখে দুটো অন্ন তুলে দেয়াই ছিল এ দেশের জন্য অনেক কঠিন কাজ। সেই দেশ এখন গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮। পাকিস্তানের অবস্থা এ সূচকে ১০৬। বাংলাদেশ ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের মতো এত দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেনি কোনো দেশ। ২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। পাকিস্তানে এ হার ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশ্ববাসী আরো একবার অবাক বিস্ময়ে জানলো বাংলাদেশকে। দেখলো লাল-সবুজের এ দেশটি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির পথে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সমৃদ্ধি বাড়ছে বাংলাদেশের। দেশপ্রধানের দূরদর্শী নেতৃত্বে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে। দেশের মানুষ এখন ক্ষুধা নিয়ে চিন্তিত নয়। মঙ্গা, খরা প্রভৃতি দুর্ভোগের শব্দ এখন বাংলাদেশে অনুপস্থিত। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে নতুন বছর ২০১৮ সাল। কারণ ৪২ বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকার পর এ রাষ্ট্র চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি পেতে চলেছে। আগামী মার্চে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটি এই স্বীকৃতি দেবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়।
বাংলাদেশের জন্য এই অর্জন অনেক মর্যাদার। কারণ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের জন্য বিবেচ্য তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে এ দেশ এ স্বীকৃতি অর্জন করতে চলেছে। এর ফলে নতুন অবয়বে সারাবিশ্বের সামনে অভ্যুদয় ঘটবে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি (সিডিপি) প্রতি তিন বছর অন্তর এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয় পর্যালোচনা করে। সিডিপি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়ে আলোচনা করতে গত অক্টোবরে ঢাকায় আসেন। প্রাথমিক হিসাব করে সিডিপি নিশ্চিত করেছে, তাদের ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় বাংলাদেশ আগামী মার্চে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার মানদণ্ড পূরণ করবে। এরপর ২০২১ সালের পর্যালোচনায় সিডিপি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করবে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনুমোদন দেবে জাতিসংঘ।
এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি সূচক বিবেচনায় নেয় সিডিপি। এগুলো হচ্ছে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। কোনো দেশ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটিতে পর পর দুটি পর্যালোচনায় (৬ বছর) উত্তীর্ণ হলে তাকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। সুখবর হলো, বাংলাদেশই প্রথম এলডিসি যে তিনটি সূচকেই শর্ত পূরণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য মার্চে যে পর্যালোচনা হবে, তাতে মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ ডলার। বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত অ্যাটলাস পদ্ধতিতে এ আয় নির্ধারণ করা হয়। জাতিসংঘের ওই কমিটির হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১২৭২ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে স্কোর থাকতে হবে ৬৬ বা তার বেশি। বাংলাদেশের স্কোর এখন ৭২ দশমিক ৮। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের স্কোর হতে হবে ২৫ বা তার কম। বাংলাদেশের স্কোর এখন ২৫।
এর আগে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এ শ্রেণিকরণ বিশ্বব্যাংকের। জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল এবং উন্নত- এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে ‘মাথাপিছু আয়’ অন্যতম মানদণ্ড। এ ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ধারণের জন্য অন্য দুটি মানদণ্ড নিরূপণ করা হয়।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সুবিধা হলো, এটি মর্যাদার। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি তারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিক ফোরামে তখন বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দেখতে হবে, এ দেশের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য বিনিয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে পরিবেশের ওপর।
সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে ফিরে আসা প্রধানমন্ত্রীর সকল ভাবনা দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন নিয়ে। দেশের শান্তিকামী মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তিসাধন এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তেই বঙ্গবন্ধু কন্যার অবিরাম প্রচেষ্টা। পিতার আদর্শকে পাথেয় নিয়ে কাজ করছেন দেশরতœ শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ সমৃদ্ধ একটি সমন্বিত কার্যকর ও সুসংহত পররাষ্ট্রনীতি এবং ক‚টনৈতিক কুশলতার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বাঙ্গনে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি অর্জন করেছে।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রা দেখে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক পরাশক্তি দেশগুলো ভ্রæ কুঁচকায়। সে দেশের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। একই দৃশ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। দেশের উন্নয়নে অন্য দেশের পরামর্শ গ্রহণ না করায় অনেক দেশই বাংলাদেশের ওপর ‘অসন্তুষ্ট’ হয়। দেশকে অসহযোগিতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদ্ধতি বেছে নেয় তারা। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রাখা প্রভৃতি এ রকমই ষড়যন্ত্রের ফল। কখনো সখনো দেশের ওপর অযাচিত শর্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে উন্নয়নের ধারা রুদ্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন না করতে চাপ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ রকম কোনো অপচেষ্টাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন হতে দেননি।
দেশনেত্রী বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশই সিদ্ধান্ত নেবে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। এখন সাহায্যের আশায় বাঙালি আর বসে থাকে না। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা আজ নিজেদের স্বাবলম্বী করতে শিখেছে। দেশের উন্নয়নে বিদেশি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন শেষ।
১৯৭৫ সালের জাতীয় দুর্যোগের সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। দীর্ঘ ছয়মাস দেশের বাইরে থাকার পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরেন শেখ হাসিনা। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠাই আমার রাজনীতি। বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য প্রয়োজন হলে এই সংগ্রামে পিতার মতো আমিও জীবনদান করতে প্রস্তুত।’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হন শেখ হাসিনা। বিপুল প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিক‚লতার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। বহুবার গৃহবন্দি হতে হয়। তাঁর রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। হামলা-মামলা পোহাতে হয়। দুঃখী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের ব্রত নিয়ে রাজনীতিতে পিতার আদর্শ নিয়ে অবিচল থাকেন অকুতোভয় এ নেতা।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের উন্নয়ন ও গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্য-পরিবর্তনে মনোযোগী হন। তাঁর নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অশান্ত ওই অঞ্চল তথা সমগ্র দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৯ সালে তাঁরই উদ্যোগে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। উন্নয়ন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ, যোগাযোগ ও যাতায়াতের অবকাঠামো নির্মাণে সাফল্য, হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিসাধন, কৃষিক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যসহ গণতন্ত্রের উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য তিনি পরিচিতি পান ‘ডটার অব ডেমোক্রেসি’ হিসেবে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত হয়। শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বেই বর্তমান সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ শীর্ষে থাকবে। ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ পরিণত হবে পূর্ণাঙ্গ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে।
স্বজন-হারানোর কষ্ট ভুলে হাসিমুখে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অকৃত্রিমভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা কেবল শেখ হাসিনারই আছে। দেশের সংকটকালীন মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তা সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখনো অবিকল্প। বিশ্ব সেরা বুদ্ধিজীবী ও সফল ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান অর্জনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন। প্রধানমন্ত্রীর হাতেই অব্যাহত থাক আগামীর বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাক্রম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আসবে আগামী উন্নত বাংলাদেশ- প্রত্যাশা এমনই।
ড. শরীফ এনামুল কবির ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ লিংক