বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সব খাতেই এই অগ্রগতি লক্ষণীয়। সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই তা দেখা যায়, অনুভব করা যায়। স্বাধীনতার আগে, ষাটের দশকে ঘরে ঘরে অন্নাভাব ছিল। কৃষি খাতে উৎপাদন ছিল কম। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। চিরায়ত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করত সবাই। উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, পানি সেচ ও বালাইনাশকের ব্যবহার ছিল খুবই নগণ্য। ষাটের দশকে সারা পৃথিবীতে সবুজ বিপ্লব শুরু হলেও বাংলাদেশে তখন তা সম্প্রসারিত হয়নি। এ দেশে ছিল চরম খাদ্যাভাব। বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল আমাদের। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পেতেন না। প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের সংকট ছিল, বাজারে ছিল উপকরণের দুর্মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহ ছিল না কৃষকদের। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। তত্কালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সিংহভাগ আসত পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি থেকে। কিন্তু পূর্ব বাংলার গরিব পাটচাষীরা তাতে লাভবান হতেন না। তামাক, চা, আখ উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হতো কৃষকদের। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। জীবনধারণের অবস্থা ছিল খুবই নিম্নমানের।শুধু পাকিস্তান আমলেই নয়, ব্রিটিশ আমলেও এ দেশের কৃষকরা ছিলেন শোষিত। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কৃষকদের প্রতিকূলে। ফলে উৎপাদনে তাদের উৎসাহ ছিল কম। প্রতি ইউনিট উৎপাদন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নমানের। ফলে এ দেশ ছিল ঐতিহাসিকভাবে একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। ব্রিটিশ আমলে গঠিত বিভিন্ন কৃষি কমিশনের প্রদত্ত প্রতিবেদনের তথ্য থেকে এখানকার চরম খাদ্য ঘাটতির চিত্রটি ফুটে ওঠে। কৃষকদের অশিক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, তাদের সার্বিক দৈন্য, কুসংস্কার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষিতে স্বল্প বিনিয়োগ ছিল কৃষিতে নিম্নমুখী উৎপাদন ও খাদ্য ঘাটতির মূল কারণ।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এ দেশে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষি উৎপাদন। ওই সময় লাঙল ছেড়ে যুদ্ধের অস্ত্র হাতে তুলে নেন অনেক কৃষক। বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধশিবিরে চলে যায় অনেক কৃষকের সন্তান। পাকিস্তানি খান সেনাদের ভয়ে দেশের অভ্যন্তরে অনেকে যাযাবর জীবন বেছে নেয়। বেঁচে থাকার আশায় এখান থেকে সেখানে, এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় অনেকে। ফলে কৃষিতে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। বিঘ্নিত হয় কৃষির নিয়মিত পরিচর্যা। প্রয়োজনীয় বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে কৃষিপণ্যের চলাচল ও বাজারজাত দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৯৭২ সালে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার চাল নাই, ডাল নাই, রাস্তা নাই, রেলওয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে, সব শেষ করে দিয়ে গেছে ফেরাউনের দল।’ ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে। তখন থেকেই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ধারণ উৎসাহিত করা হয়। সহজ ও সুলভ করা হয় কৃষি উপকরণ সরবরাহ। পানি সেচ সম্প্রসারিত করা হয়। অনেকটা নিশ্চিত করা হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সংগত মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছে কৃষকদের। বেড়েছে কৃষির সার্বিক উৎপাদন। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। পরনির্ভরতা খুবই কম। চাল উৎপাদনে এখন আমরা উদ্বৃত্ত। এক্ষেত্রে ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে আমাদের স্থান সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, পাট রফতানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়। ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। ১৯৭২ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে চার কোটি টনেরও ওপরে। গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবস্থার উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে। এ সময় সারা বিশ্বের গড় উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল সারা বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে ওপরে। এ সময় গম উৎপাদন বেড়েছে বার্ষিক গড়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশের হারে, ভুট্টা ১৬ শতাংশ হারে, ডাল ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। তৈলবীজ ৪ শতাংশ হারে, আলু ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হারে এবং সবজি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। এখন মৎস্য ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ম্ভর। দুধ ও ডিম উৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। আশা করা যায়, আগামী পাঁচ বছরে এ ঘাটতি মিটিয়ে স্বয়ম্ভর হবে দেশ। বর্তমান অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রায় ১ লাখ টন চাল রফতানির উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত বছর আলু রফতানি করা হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের। মাছ রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে বছরের পর বছর। বাড়ছে সবজি রফতানি। চিরকালের খাদ্য ঘাটতি, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই বিপুল উন্নয়ন। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (কৃষি ও কৃষক, জাহাঙ্গীর আলম, পালক পাবলিশার্স, ঢাকা ২০১০)। বঙ্গবন্ধু জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের এক গ্রামে, টুঙ্গিপাড়ায়। ওই সময় বাংলাদেশে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা ছিল কৃষি। অবহেলিত ও বঞ্চিত ছিলেন কৃষক। তারা ছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ধান, পাট, সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ইত্যাদির চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতে হতো কৃষকদের। হালের গরু আর দুধেল গাই প্রতিপালন ও মাছ চাষ করে তাদের কিছু বাড়তি আয় হতো। হাঁস-মুরগি প্রতিপালন করে পেতেন ডিম, মাংস। এভাবেই চলত তাদের সংসার। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই এদের কষ্ট দেখেছেন। অবহিত হয়েছেন এদের বঞ্চনা ও নিরীহ জীবনধারা সম্পর্কে। বড় হয়ে যখন রাজনীতিতে এসেছেন তখন এদের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। মানসপটে এদের মুক্তির ছবি এঁকেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন যে বাংলার কৃষককুল কত পরিশ্রম ও গায়ের ঘাম ঝরিয়ে সব মানুষের অন্ন জোগায়। অথচ জীবনভর তাদের অভাব মেটে না, সুদিনের দেখা মিলে না। সেজন্য তিনি কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন তাদের মঙ্গল নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু ওই নির্বাচনী জোটের অংশীদার ছিলেন। প্রার্থী হন কোটালিপাড়া-গোপালগঞ্জ আসনে। ওই জোটের ২১ দফা কর্মসূচির মধ্যে প্রধান ছয়টি দফাই ছিল কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য নিবেদিত—
১. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সব খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায়সংগতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে।
২. পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেঙ্কারি তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।
৩. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে এবং সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে
৪. পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্পের ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হইবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে এবং তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হইবে ৫. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে ৬. পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে।
উল্লিখিত একুশ দফার ছয় দফার মধ্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। খাজনা হ্রাস ও সার্টিফিকেট কেইস রহিত করার অঙ্গীকার ছিল। বাংলার পাটচাষীদের বঞ্চনার কথা বিবেচনা করে পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। খাল খনন ও সেচের মাধ্যমে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। সর্বোপরি দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জোটের অন্যতম একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ওই নির্বাচন প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম একজন প্রণেতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর এর শরিক দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তিনি পরবর্তী কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এভাবে তিনি পঞ্চাশের দশকে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষকদের মঙ্গলের জন্য কাজ করার সুযোগ পান।
পাকিস্তান আমলে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আলাপচারিতা ও বক্তৃতার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রামীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। তার ’৭০ সালের ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে তিনি সেই চিত্রের কিছুটা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলার বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। জনগণকে সেই অনাহার থেকে রক্ষা করতে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে যেক্ষেত্রে প্রতি মাসে মোটা চালের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে সে চালের দাম ছিল গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাংলায় যে আটার দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের সরিষার তেলের দাম ছিল আড়াই টাকা, বাংলাদেশে তার দাম ছিল ৫ টাকা। এসব উদাহরণ টেনে তিনি বাংলাদেশের কৃষক ও গ্রামীণ মানুষের দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। সেই সঙ্গে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে সামন্ত প্রভুদের অফুরন্ত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং গরিব কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সামন্ত প্রভুরা রাজকীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে। তারা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তাদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকদের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে।’ ওই ভাষণে তিনি ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ ও বকেয়া খাজনা মওকুফের অঙ্গীকার করেন। পাটচাষীদের সুরক্ষার জন্য তিনি পাট ব্যবসা জাতীয়করণ ও পাট গবেষণা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি চাষীদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি কৃষি বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক বলে দিকনির্দেশনা দেন। তার ভাষণের সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
‘এ-যাবৎ বাংলার সোনালি আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া ব্যাপারীরা পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করছে। পাটের মান, উৎপাদনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবস্থা জাতীয়করণ, পাট গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। তুলার প্রতি একই ধরনের গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সেজন্য আমরা মনে করি, তুলা ব্যবসাও জাতীয়করণ করা আবশ্যক। তুলার মান ও উৎপাদনের হার বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। বিগত সরকারগুলো আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল চা, আখ ও তামাকের উৎপাদনের ব্যাপারেও যথেষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। ফলে এসব অর্থকরী ফসল আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থায় বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
ভূমি রাজস্বের চাপে নিষ্পিষ্ট কৃষককুলের ঋণভার লাঘবের জন্য অবিলম্বে আমরা ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ এবং বকেয়া খাজনা মওকুফ করার প্রস্তাব করেছি। আমরা বর্তমান ভূমি রাজস্ব প্রথা তুলে দেয়ার কথা ভাবছি। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক তত্পরতা চালাতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের বনজ সম্পদ, ফলের চাষ, গো-সম্পদ, হাঁস-মুরগির চাষ, সর্বোপরি মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। পানিসম্পদ গবেষণা ও নৌ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য অবিলম্বে একটি নৌ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। …বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রথম কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে একটি সুসংহত ও সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা আশু প্রয়োজন।’
’৭০-এর ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। তারপর তিনি প্রদান করেন তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা। তাতে তিনি কৃষি ও কৃষকের স্বার্থের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। আইয়ুবি আমলে বাস্তুহারা হয়েছে বাংলার মানুষ। সরকারের খাসজমি বণ্টন করা হয়েছে ভূঁইওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে এদের কাছ থেকে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। ভবিষ্যতে সব খাসজমি বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমি কৃষক ও শ্রমিকদের কথা দিচ্ছি, আওয়ামী লীগ তাদের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই। এরা কেউ এমনকি আমি নিজেও যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, তবে আমাদের জীবন্ত কবর দেবেন।’ [সূত্র: জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, বাংলাদেশ কালচারাল ফোরাম, ঢাকা।]
’৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্ব্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনায় আগ্রহী ছিলেন তিনি। দেশের সাধারণ কৃষক, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ও শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের অভিপ্রায় ছিল তার, কিন্তু পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য থেকে তিনি তা করার সুযোগ পাননি। বারবার আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করেও তা স্থগিত করেন পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তিনি বাংলার সংগ্রামী জনগণের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করেন। অবশেষে চরম আঘাত হানেন ২৫ মার্চের কালরাতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে। অতঃপর তিনি গ্রেফতার হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে। দীর্ঘ নয় মাস বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিজয় সূচিত হয় ১৬ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ ডিসেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। অতঃপর ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি একের পর এক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেন। তান মধ্যে দেশের কৃষিতে ও কৃষকের উন্নয়নে গ্রহণ করেন অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কৃষকদের কল্যাণে যেসব কর্মসূচি গ্রহণের কথা বলেছেন, ’৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে কৃষি উন্নয়নের জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি জনগণকে দিয়েছেন, তার পূর্ণ প্রতিফলন ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচিতে।
বঙ্গবন্ধু সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর কৃষিক্ষেত্রে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম ছিল ভূমি সংস্কার। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ’৯৬ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির সব খাজনা রহিত করেন। তাতে বছরে প্রায় ৭ দশমিক ৫৪ কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। রাষ্ট্রপতির ৯৮ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তাতে ৫ হাজার ৩৭১টি পরিবার থেকে ৭৬ হাজার ৭১২ একর জমি সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ওই জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। তাছাড়া আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তুলেন গুচ্ছগ্রাম। নতুন জেগে ওঠা চর ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করেন বিনা মূল্যে। গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের বাঁচানোর জন্য তাদের রেশনের আওতায় নিয়ে আসেন।বাংলাদেশের কৃষকদের ঋণগ্রস্ততার কথা বঙ্গবন্ধু ভালোভাবে জানতেন। তাদের আর্থিক দুর্দশা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। তাই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পকিস্তান আমলে নেয়া কৃষকদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। তাদের বিরুদ্ধে করা সব সার্টিফিকেট কেইস তিনি প্রত্যাহার করে নেন। উচ্চসুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য এবং তাদের কাছে অবাধে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গ্রামবাংলার কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করা এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দেশের কৃষকদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড় অবদান রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লবের বিকাশের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না’ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অর্থনীতি, শাহাদাত হোসেন, চিত্রা প্রকাশনী, ঢাকা,২০১০]। এ কৃষি বিপ্লবে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি কৃষি উপকরণের ওপর উদার সহায়তা প্রদান করেন। রাসায়নিক সার বিতরণের ব্যবস্থা করেন প্রায় অর্ধেক মূল্যে। ১৯৭২ সালে সেরপ্রতি (প্রতি কেজি প্রায়) ইউরিয়া সারের মূল্য ছিল আট আনা (২০ টাকা মণ), টিএসপি সারের মূল্য ছিল ৬ আনা (১৫ টাকা মণ) এবং এমওপি সারের মূল্য ছিল চার আনা (১০ টাকা মণ)। একটি গভীর নলকূপের দাম ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেটি কৃষক সমবায়কে দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট প্রদানের মাধ্যমে। প্রতি ইউনিট পাওয়ার পাম্পের দাম ছিল প্রায় ২২ হাজার টাকা। সেটি ভাড়ায় দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০০ টাকায় [Mosharaff Hosain, Agriculture in Bangladesh, UPL, Dhaka,1991]। আধুনিক বীজ সরবরাহ করা হয়েছে নামমাত্র মূল্যে। পোকার ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় বিনা মূল্যে। তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও টিলার সরবরাহ করেন। তাতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ পড়ে কম। অন্যদিকে তিনি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেন। ধান, পাট, তামাক, আখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করে দেন। এভাবে তিনি কৃষির উৎপাদনকে লাভজনক করে তোলেন দেশের কৃষকদের জন্য। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সমাজে চাষীরা হলেন সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ তার এই অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে দেশের তত্কালীন বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায়।
১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের শরিকানা ছিল ২০ শতাংশ। তার নেতৃত্বের প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিবেচনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল কৃষি উন্নয়নের ওপর। এজন্য তিনি সর্বাগ্রে কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচি জোরদার করেন। খাদ্যে স্বয়ংম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে জয়দেবপুরের বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করেন। ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রতিষ্ঠিত এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে। তাছাড়া তিনি ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিষ্ঠিত করেন আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সরকারের কৃষি গবেষণা বিভাগকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠনের জন্য তিনিই উদ্যোগ নেন এবং এ কাজে ড. কাজী এম বদরুদ্দোজাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। তাছাড়া জাতীয় পর্যায়ে কৃষি গবেষণার সমন্বয় সাধন ও মান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এস ডি চৌধুরীকে নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে নির্বাহী চেয়ারম্যান) করে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। সেই সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে পুনর্গঠিত ও সম্প্রসারিত করেন। তিনি উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, তুলা উন্নয়ন বোর্ডসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণ সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য। তিনি মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বিদ্যমান কার্যক্রম ও অবকাঠামো সম্প্রসারিত করেন। মত্স্য ও পশুসম্পদের উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষকদের মাঝে ১ লাখ হালের বলদ ও ৫০ হাজার গাভী সরবরাহ করেন ভর্তুকি মূল্যে। গরিব কৃষকদের মাঝে তিনি সহজ শর্তে ১০ কোটি টাকার ঋণ ও ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বিতরণ করেন।
তাছাড়া কৃষির সব উপখাতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষক পর্যায়ে তার সম্প্রসারণ এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের জন্য তিনি বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর একটি বড় সাফল্য ছিল ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদন। ওই চুক্তি মোতাবেক এপ্রিল-মে মাসের শুকনো মৌসুমে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নেবে, কিন্তু বাংলাদেশ পাবে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি। পরে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ওই চুক্তি কতটা কার্যকর ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই ভারতের সঙ্গে ওই চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে পানি সেচের জন্য বঙ্গবন্ধু ভূ-উপরিস্থিত পানি কাজে লাগানোর ওপর তাগিদ দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ তিনি ২০ হাজার পাওয়ার পাম্প সরবরাহ করেন। তাছাড়া ভূর্গভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য তিনি ১০০ অগভীর নলকূপ এবং ৯৪টি গভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করেন কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মিবাহিনী। এরাই গবেষণা করবে এবং গবেষণার ফলাফল মাঠে পৌঁছে দেবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য।
সে কারণে কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুু ছুটে যান ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভাষণ দেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের এক সমাবেশে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য কারিগরি গ্র্যাজুয়েটকে (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার) অনুরূপ কৃষি গ্র্যাজুয়েটের চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা নিশ্চিত করেন। তাদেরকে টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ভাতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে তাতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কৃষিশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবেন। তিনি তাদের শিক্ষাজীবন শেষে মাঠে নেমে কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমাদের নজর গ্রামের দিকে দিতে হবে। কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের তিনি কৃষি বিপ্লব সফল করার আহ্বান জানান। দেশের কৃষিশিক্ষায় শিক্ষিত প্রায় ৩০ হাজার গ্র্যাজুয়েট আজও বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানের কথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনের ওই দিনটিকে তারা পালন করেন জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে। কৃষি উন্নয়ন বলতে বঙ্গবন্ধু শস্য, মত্স্য-পশুপাখি ও বনসম্পদ অর্থাৎ সার্বিক কৃষি খাতের উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, খাদ্য শুধু চাল, আটা নয়; মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারিও আছে।’ তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় আমাদের উর্বর জমি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, পশু-পাখি, মত্স্য, বনাঞ্চল ও পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছেন। এসবের ওপর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে তিনি খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের নিদের্শনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না।
আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।’ এর সঙ্গে তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অভিঘাত সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ে তোলা। একে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘সোনার বাংলা’ বলে। এ স্বপ্নের দেশটি গড়ার লক্ষ্যে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পরিকল্পিত অর্থনীতি। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) শুরু হয় ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে। এর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। কৃষি খাত এর অন্তর্ভুক্ত। ওই সময় জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৬ শতাংশ। মোট শ্রমশক্তির সিংহভাগই নিয়োজিত ছিল কৃষি খাতে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই পরিকল্পনাটিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল ওই খাতের উন্নয়নের ওপর। উদ্দেশ্য ছিল দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানির পরিমাণ হ্রাস করা। গ্রামের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান করে তাদের আয় বৃদ্ধি করা। গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস ও আয়বৈষম্য দূর করা। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ওই লক্ষ্য অর্জনের পথে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিল গ্রামীণ অর্থনীতি। তবে চুয়াত্তরের বন্যার কারণে বিঘ্নিত হয় কৃষি উৎপাদন। ফলে বৃদ্ধি পায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য। তবে পরবর্তী বছরে তা সামলে ওঠা সম্ভব হয়। খাদ্যশস্য উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির পরিমাণ হ্রাস পায়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল থেকে পরিস্থিতির বেশ উন্নতি ঘটে। চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ৫ দশমিক ৫ টাকায় এবং আলুর দাম কেজিতে ২ থেকে ১ দশমিক ৫ টাকায় নেমে আসে [কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু, শামসুল আলম, পার্ল পাবলিকেশনস, ঢাকা, ২০২০]। ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসে গ্রামীণ জীবন। কৃষিকাজে পুরোদমে আত্মনিয়োগ করেন দেশের কৃষক।
বঙ্গবন্ধু আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকের দারিদ্র্য এবং জমির খণ্ডবিখণ্ডতাকে উত্পাদন বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই তিনি কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার ভাবনা ছিল প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে আধুনিক চাষাবাদ হবে। সম্ভব হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। ফলে উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষিপণ্যের বাজারজাত সম্ভব হবে। তাতে উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যাবে। এর মাধ্যমে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক ও যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের কৃষকরা সব প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন। তাই তিনি সমবায়কে সংবিধানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে সমবায় মালিকানার স্পষ্টায়ন রয়েছে। দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য সমবায়কে হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায়কে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয় তার আমলেই। এছাড়া বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, কুমিল্লা কর্তৃক সার্বিক গ্রাম উন্নয়নের জন্য গ্রহণ করা হয় একটি পাইলট প্রকল্প। তদুপরি দেশের গরিব কৃষক ও সহায়-সম্বলহীন মানুষের আর্থিক উন্নয়নের জন্য চালু করা হয় সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ। পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ খাতে বরাদ্দ করা হয় ৯০ লাখ টাকা। ১৯৭২ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সম্মেলনে ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে—এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উত্পাদন যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উত্পাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষী গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে। জোতদার ধনী চাষীর শোষণ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবে সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একইভাবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উৎপাদনের মাধ্যমে একত্র করতে পারেন, তবে আর মধ্যবর্তী ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না।
সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামবাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প, যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত দুঃখী মানুষ। সমাজতন্ত্র স্থাপনের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই সমস্ত বড় শিল্প, ব্যাংক, পাটকল, চিনিকল, সুতাকল ইত্যাদি জাতীয়করণ করেছি। জমির সর্বোচ্চ মালিকানা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আজ সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামে গ্রামে, থানায়, বন্দরে গড়ে তুলতে হবে মেহনতি মানুষের যৌথ মালিকানা। কৃষকরা তাদের উত্পাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল ভোগের ন্যায্য অধিকার।’ বঙ্গবন্ধু দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে সমবায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এর সদস্য হতো গ্রামের সব মানুষ। তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যৌথ কৃষি খামার। সরকার তাতে ঋণ দেবে, উপকরণ সহায়তা দেবে, সেচের ব্যবস্থা করে দেবে। তাতে কৃষির উত্পাদনশীলতা বাড়বে। তার সুফল পাবে জমির মালিক, শ্রম প্রদানকারী ভূমিহীন কৃষক ও সরকার। তবে জমির মালিকানা কৃষকেরই থাকবে। এক্ষেত্রে ভয় না পাওয়ার জন্য কৃষকদের তিনি আশ্বস্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে পাঁচ বছরের প্ল্যান, প্রত্যেকটি গ্রামে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে। বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রাম কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেক মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। …ভুল করবেন না।
এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি, তাতে আমি আপনাদের জমি নেবো না। ভয় পাবেন না যে জমি নিয়ে যাব, তা নয়। এ জমি মালিকের থাকবে। আপনার জমির ফসল আপনি পাবেন। কিন্তু ফসলের অংশ সবাই পাবে। …এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে, আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এজন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে।’ বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য সংকট নিরসনের জন্য খাদ্য উত্পাদন বাড়াতে চেয়েছেন। ফসলের বহুধাকরণ চেয়েছেন। ফসলের মৌসুম পরিবর্তন করতে বলেছেন। শীত মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে কম। তখন ফসল ফলানোর সুযোগ থাকে বেশি। সেজন্য শীতকালীন ফসলের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। পানি সেচের সুবিধা সম্প্রসারণ করতে চেয়েছেন। জমির ফসল উত্পাদনের নিবিড়তা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি একর জমির উত্পাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ ফসল হয়।
কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিন গুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা কাপড় পরা ভদ্রলোক, তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে, ডাবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাল্লাহ হবে না’ [সূত্র: বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা, শাজ্জাদুল হাসান, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ আগস্ট, ২০১৯]। বঙ্গবন্ধু আজ নেই। তিনি লোকান্তরে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে সেই অভাব আর দৃষ্টিগোচর হয় না। দেশের কৃষি উত্পাদন ডাবল, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি হয়েছে। আমাদের এখন খাদ্য সংকট নেই। খাদ্যশস্য উত্পাদনে আমরা এখন উদ্বৃত্ত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে কৃষি উন্নয়নের এক অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষকদের জন্য তিনি উদার সহায়তা দিচ্ছেন। সব দুর্যোগে ও দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এ দেশের কৃষক এখন আর শোষিত ও বঞ্চিত নন। তারা সম্মানিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার এক কালজয়ী ভাষণে দেশের কৃষকদের ইজ্জত দিয়ে কথা বলতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক। …ওদের সম্মান দিয়ে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার ওই নির্দেশনাকে অন্তরে ধারণ করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে তা পালন করেছেন। তিনিও পিতার ওই নির্দেশনার অনুকরণে প্রাণের সব মমতা ঢেলে দিয়ে বলেছেন, গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছেন আমাদের কৃষকরা। তারা মানুষের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছেন। তাই দেশের কৃষকদের আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত। এদের সবচেয়ে সম্মান দেয়া উচিত [সূত্র: কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, জাহাঙ্গীর আলম, পালক পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৯]। এ বিষয়টি আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকা দরকার।
[সূত্র: ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮০৯, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।]
ড. জাহাঙ্গীর আলম
কৃষি অর্থনীতিবিদ; উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট
গবেষণা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকপ্রাপ্ত
Link: Banikbarta | সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০