বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রীদের জানতেন

বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রীদের জানতেন

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

পনের আগস্ট সকাল। তখনও সূর্যের আলো ফুটে ওঠেনি। কাকডাকা ভোর। হঠাৎ মেশিনগান ও কামানের গোলার বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আশপাশের বাড়ির সবাই প্রায় ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই হতচকিত- কী হলো দেশের অভ্যন্তরে! তখনও কামানের গোলা দু-একটি বিস্ম্ফোরিত হচ্ছে।

এ সময়ে ইত্তেফাকের চৌকস ফটোগ্রাফার আলম দৌড়াতে দৌড়াতে আমার বাসায় এসে উপস্থিত। চিৎকার করে কেঁদে উঠে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দীদার ভাই, ওরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে! আলম বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় ফটোসাংবাদিক। সে জন্য বঙ্গবন্ধু তাকে তার ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার করে নিয়োগ দিয়েছিলেন। দেশে-বিদেশে আলম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবসম থাকত।

আমি ভাবছি, আলমের এই ভয়োক্তি সম্ভবত তার উত্তপ্ততাজনিত। তাই আমি বললাম, কী পাগলের মতো কথা বলছ! বঙ্গবন্ধুকে কেন মেরে ফেলবে? আজ তো বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রাম। আমি তো সেখানে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি।

আলম জানাল, সে সকালের স্নিগ্ধ বাংলাদেশ এবং সকালে কিছু বিরল পাখির ছবি তোলার জন্য গণভবনের পাশে ক্রিসেন্ট লেকের পার্কে (চন্দ্রিমা উদ্যান) এসেছিল। চন্দ্রিমা উদ্যানে মোটরসাইকেল রেখে সে মডেল স্কুলের কাছে আসার পরপরই এই গোলাগুলি। তার দৃঢ়বিশ্বাস, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। সেদিকে তখন মিলিটারির গাড়ি এবং মিলিটারিরা রাস্তায় পাহারারত। যাওয়ার উপায় নেই। আলম আরও বলল, জানি, আপনি এখানে থাকেন; তাই দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার বাসায় এসেছি। আমি তখন মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় থাকি। আমার বাসার কাছেই ইত্তেফাকের আরেক ফটোসাংবাদিক আফতাব বসবাস করে।

আলম কথা বলতে বলতে কিছুটা হলেও বিকারগ্রস্তভাবে কাঁদছিল ও বলছিল, আমাদের কী হবে, দেশের কী হবে? দীদার ভাই, আপনি এখনই একবার বঙ্গবন্ধুর বাসায় যান। দেখেন, সেখানে কী হয়েছে। আমি আলমকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মোটরসাইকেল কোথায়? ও বলল, চন্দ্রিমা উদ্যানে রেখে এসেছি। তা ছাড়া আমি সেখানে গেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা জানে, আমি বঙ্গবন্ধুর ফটোগ্রাফার। তার কথা শুনে দ্রুততার সঙ্গে আমি তৈরি হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে অফিসের দিকে রওনা হলাম। অফিস যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ৩২ নং ধানমন্ডি পড়ে। সে পথে যাওয়ার সময় দেখলাম, আর্মিরা পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। যাতায়াত করতে দিচ্ছে না।

আমি আমার প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড (সিকিউরিটি কার্ড) তাদের দেখিয়ে বললাম, আমি একজন সাংবাদিক; এখানে যাওয়ার অধিকার আমাকে দেওয়া হয়েছে। একজন আর্মি অফিসার এসে জানাল, ৩২ নং রাস্তায় কারও যাওয়ার পারমিশন নেই। আপনি সোজা বেরিয়ে যান। বাধ্য হয়ে আমি কলাবাগান হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি হয়ে আমার অফিস সেগুনবাগিচায় এসে পৌঁছলাম। কলাবাগানে একটি ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সবাই জানেন। আমার এই ঘটনার কথা আগস্ট মাস এলেই বারবার একটি আলাপচারিতার কথা মনের অগোচরেই এসে হাজির হয়।

আমি তখন ইউএনআই এবং এনা সংবাদ সংস্থায় কাজ করি। ইউএনআই পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নিউজ অর্গানাইজেশন। দিল্লি থেকে ইউএনআইর ব্যুরো চিফ হিসেবে মহেন্দ্র ভেদকে ঢাকায় পাঠান হলো। আমি ব্যুরো চিফের সহকর্মী হিসেবে ১৯৭২ থেকে কাজ করছি এই ইউএনআইতে।

আমাদের ইউএনআইর অফিসে তখন প্রায়ই সাংবাদিকদের আড্ডা হতো। সব সিনিয়র সাংবাদিক এসে জড়ো হতেন আমাদের অফিসে। চা পান, খোশগল্প হতো। রাজনীতি থেকে দেশ-বিদেশের রাজা-বাদশাহ সম্পর্কে নানা রকম মন্তব্য-সমালোচনা হতো ওই ক্ষুদ্র আলোচনা সভায়। এখানে তখন ভারতের কয়েকটি নিউজ অর্গানাইজেশন কাজ করত। ইউএনআই, পিটিআই, আকাশবাণী, হিন্দুস্তান টাইমস, স্টেটসম্যান পত্রিকাগুলোও তাদের অফিস ঢাকায় খুলেছিল। প্রধানত, তারা ইউএনআই অফিসে এসে আড্ডা জমাত। নানা প্রকার গল্পগুজব করত।

ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় হাইকমিশনে ব্রিফিং মিটিং হতো। প্রধানত ভারতীয়রাই এই ব্রিফিং মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। যখন ইউএনআইর ব্যুরো চিফ ঢাকায় থাকতেন না, তখন মাঝেমধ্যে আমাকে ওই ব্রিফিং মিটিংয়ে থাকতে বলা হতো। এই ব্রিফিং মিটিংগুলো সাধারণত ভারতের স্বার্থ রক্ষার কথা বিবেচনা করেই সংবাদ পাঠানোর জন্য বলা হতো। আমি থাকলে স্বাভাবিক আলোচনা হতো। কোনো গুরুতর বিষয়ের অবতারণা হতো না।

একদিন হঠাৎ দীপ্ত সেন, হিন্দুস্তান টাইমসের ঢাকা ব্যুরো চিফ, যিনি আমাদের ইউএনআই অফিসেই থাকতেন পেয়িং গেস্ট হিসেবে; আমার সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিষয়ে জানতে চাইলেন। আমরা খোলামেলা আলোচনা করতাম। আমরা প্রায় সবাই সমবয়সী এবং সবাই সিনিয়র সাংবাদিক। আমার গতিবিধি একটু অবাধ ছিল। কারণ আমি দু-জায়গায় ইউএনআই এবং এনাতে কাজ করতাম বলে।

যোগাযোগও আমার বেশি ছিল। রাজনৈতিক কারণে এবং সাংবাদিকতার জন্য আমার পরিচিতি বেশি ছিল। নানান পেশার লোকের সঙ্গে সাংবাদিকদের কমবেশি যোগাযোগ রাখতে হয়। আবার অন্য পেশার লোকরাও সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আমি বঙ্গভবন, ফরেন মিনিস্ট্রি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। সাংবাদিকদের রাখতে হয়।

আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় এনএসআই অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন। আমরাও যেতাম। তার সঙ্গে রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হতো। এনএসআইয়ে কাজ করার সুবাদে তার ইনফরমেশন সোর্স বেশ ভালো ছিল। আমি তার সঙ্গে আলাপ করে অনেক সময় স্কুপ নিউজ করেছি। মাঝেমধ্যে তিনি আমার কাছে জানতে চাইতেন, ভারতীয় সাংবাদিকরা বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন। আমিও অনেক কথা বলতাম। তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা মাঝেমধ্যে মন্তব্য করত। তাই নিয়ে আমাদের মাঝে তর্কবিতর্ক হতো।

একদিন দীপ্ত সেন হঠাৎ বলে বসলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজত্বের দিন হয়তো শেষ হতে চলেছে। আমরা বললাম, এটা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর কোনো রিপ্লেসমেন্ট এখনও নেই। তিনি অম্লান বদনে বললেন, কেন? খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি হয়তো বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন; তেমন আলামতও আছে।

আমি এনএসআইর ওই ডেপুটি ডিরেক্টরের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে দীপ্ত দাদার অভিমতের কথা বললাম। তখন জানতাম না আমাদের আলাপ-আলোচনার সার-সংক্ষেপ এনএসআইর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হয় এবং সেই অভিমত স্বয়ং রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হয়।

আমাদের আলোচনার একদিন পর এনএসআইর ওই ডেপুটি ডিরেক্টর বললেন, তার ডিজি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, দীপ্ত সেনের উক্তি সম্পর্কে অথেনটিসিটি কী; এর কোনো তথ্য আমার জানা আছে কিনা? এর পর ডিজি আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। আমি বললাম, এর বেশি তথ্য আমার জানা নেই। আমি তাকে বললাম, এটা আমাদের মধ্যে রাজা-উজির নিয়ে সমালোচনার অঙ্গ বলে মনে হয়। এ রকম আলাপ হরহামেশাই আমাদের মধ্যে হয়। আমি এনএসআইর ডেপুটি ডিরেক্টরকে খুব বকাবকি করলাম। যা হোক তিনি আমাকে জানালেন, এই তথ্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে অবহিত আছেন বলেও মতামত দিয়েছেন।

এনএসআইর কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, এটা প্রতীয়মান, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে- এটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন। তাকে গোয়েন্দা বিভাগ বারবার সতর্ক করেছে। কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন তাদের মতামত। বঙ্গবন্ধু নিজের ওপর এতই আস্থা ছিল যে, তাকে কেউ হত্যা করতে পারে বলে বিশ্বাসই করতেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, বাঙালিরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তারা আমাকে ভালোবাসে, আমি তাদের ভালোবাসি। তাদের সুখ-দুঃখের সমান ভাগীদার আমি। আমার কোনো ক্ষতি তারা করতে পারে না।

গোয়েন্দা বিভাগ থেকে তাকে বারবার বলা হয়েছিল তার সিকিউরিটি বাড়ানোর জন্য। তিনি তা শোনেননি। ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা খুব সহজেই তার প্রতি আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগ থেকে তাকে গণভবনের বাসায় থাকতে বলা হয়েছিল। তিনি তাও অস্বীকার করেন। জনগণের ওপর এতটাই তার বিশ্বাস ছিল যে, তিনি তার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে- বিশ্বাসই করতেন না।

‘জেনে শুনে বিষ করেছি পান’- কবিগুরুর গানের এই চরণ বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণে প্রমাণিত হলো- স্বেচ্ছায় তিনি নিজেকে ষড়যন্ত্রকারীদের সহজ টার্গেটে পরিণত করেছিলেন। মহাভারতের অজেয় বীর যোদ্ধা ভীষ্ফ্মের স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো তিনি নিজের মৃত্যু পরোয়ানা স্বেচ্ছায় ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তুলে দিলেন। কলঙ্কিত ইতিহাস রচিত হলো বাঙালির বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথায়।

সৈয়দ দীদার বখ্‌ত
রাজনীতিক; সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী
সমকাল, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, লিঙ্ক

আরও পড়ুন