বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

উনিশশো পঁচাত্তরের আগস্টে এক ভয়ংকর কালরাত এসেছিল বাংলা ও বাঙালির জীবনে। ঘোর এক অমানিশা। সেই ভয়াল রাতে পিশাচেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটা জাতির স্রষ্টাকে, একটা দেশের জন্মদাতাকে, বাংলার মানচিত্রব্যাপী বিস্তার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহীরুহকে সমূলে উৎখাতের জন্য। তারা প্রায় পুরোপুরি সফল হয়েও গিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পুরো পরিবারকে সে-রাতেই প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল তারা। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নির্দেশে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন সেই মহীরুহ থেকে জন্মানো দুটো চারাগাছ। অনাগত দিনে, জনকের অনুপস্থিতিতে জাতিকে সংগ্রামে, সংকটে, উৎসবে, অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দেওয়ার গুরুদায়িত্ব সেদিন থেকেই অগোচরে প্রতীক্ষায় ছিল তাদের জন্য।

সেদিনের সেই দুই চারাগাছ আজ নিজেরাই মহীরুহশেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর এ দুই কন্যা যেন সূর্য আর চাঁদ।

বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও কখনো সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে আসেননি শেখ রেহানা। বড়বোন শেখ হাসিনার শুভানুধ্যায়ী হিসেবে সরকার ও দলকে অবিরাম সাহায্য-সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন নেপথ্য থেকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ সক্রিয় রাজনীতিবিদদের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম শেখ রেহানা। সর্বোপরি, রাজনীতির বাইরেও জনহিতৈষী কাজে সব সময়েই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন জনকের অতি আদরের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের বাকিরা যখন নিহত হন, রেহানা তখন বড়বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন জার্মানির কার্লস্রুইয়ে-তে ভগ্নিপতি বিজ্ঞানী শেখ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থলে। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ জনকের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটা যখন তাদের কাছে পৌঁছায়, তখন তারা বেলজিয়াম ভ্রমণরত ছিলেন। জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মন্তুদ ঘটনাটির পর নীড়হারা দুটো পাখির ছানার মতোই কার্লস্রুইয়ে থেকে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। সে-সময়ে তাদের দেশে ফেরার কোনো উপায় ছিল না। ফিরলেই তাদেরও হত্যা বা কারারুদ্ধ করত সেই সময়ে ক্ষমতাসীন পিতৃহন্তারা। আরও পরে রেহানা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে ব্রিটিশ সরকার তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আজ অব্দি সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন শেখ রেহানা। মাঝেমাঝে স্বদেশে এসে কিছুদিন থেকে যান।

প্রবাস জীবন যাপন করলেও দেশের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক কখনোই ছিন্ন বা ক্ষুণœ হয়নি। দেশপ্রেম তার ধমনী-শিরায় স্বতঃপ্রবাহিত শোণিতের মতো। নিজের তিন সন্তান আজন্ম বা আশৈশব ব্রিটিশ নাগরিক হলেও, তাদেরও তিনি শিখিয়েছেন ব্রিটেনকে ভালোবাসার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসাকেও সবার ওপরে রাখার কথা।

পারিবারিক মহান উদারনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিচর্চার ঐতিহ্য রক্ষা করে শেখ রেহানার বড় মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে যোগ দেন। লেবার পার্টির পক্ষ থেকে ২০১০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১৪ পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। ২০১৫-তে সংসদ নির্বাচনে তিনি হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্ন থেকে লেবার পার্টির প্রার্থী হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ রেহানার একমাত্র ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক লন্ডনে ‘কন্ট্রোল রিস্কস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ভূম-লীয় ঝুঁকি বিশ্লেষণ বিষয়ক সম্পাদক।

২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করে। দেশ ও দলের সেই ভয়াবহ ক্রান্তিকালে বড়বোন শেখ হাসিনার পক্ষে নেপথ্যে থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের হাল ধরেন শেখ রেহানা। ২০০৮-এ বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করার এবং শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ রেহানা ইংল্যান্ডে তার পরিবারের কাছে ফিরে যান।

শেখ রেহানার বিয়ে হয় ১৯৭৭-এর জুলাই মাসে লন্ডনের কিলবার্নে, মুজিব পরিবারের সুসময়ের-দুঃসময়ের চিরসঙ্গী, বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত সিদ্দিক তখন ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছিলেন। আগেই বলেছি, শেখ রেহানাও তখন পনেরোই আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জার্মানি, ভারত হয়ে যুক্তরাজ্যে এসে তখন তাদের প্রিয় খোকা চাচার কাছে থাকছিলেন। শফিক সিদ্দিকের পরিবার ও বঙ্গবন্ধু পরিবার পরস্পর পূর্বপরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, ইতিপূর্বে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার জীবৎকালেই পারিবারিকভাবে শফিক ও রেহানার বিয়ের পাকা কথা হয়েছিল। সব ঠিকঠাক থাকলে শেখ রেহানা জার্মানি ভ্রমণ করে ফেরার পর বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু পনেরোই আগস্টের হত্যাকান্ডের পর দেশে ফেরা এবং বেঁচে থাকাই যেখানে অনিশ্চিত হয়ে যায়, সেখানে বিয়ের প্রশ্নই তো উঠতে পারে না।  মর্মঘাতী শোক ও ক্ষতির ধাক্কা সামলে প্রবাসজীবনে শেখ রেহানা একটু থিতু হলে পর মরহুম বাবা-মায়ের নির্বাচিত পাত্র শফিক সিদ্দিককে বিয়ে করে মূলত জনক-জননীর প্রতিই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে এখনো কর্মজীবী হিসেবেই জীবন কাটান শেখ রেহানা। স্বামী অধ্যাপক শফিক সিদ্দিক বর্তমানে অবসর নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষণ ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ থেকে।

বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ রেহানার জন্মদিন ১৩ সেপ্টেম্বর। ১৯৫৫ সালের এই তারিখে জননী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কোল আলো করে তার জন্ম হয়েছিল। জনহিতৈষী কর্মকান্ডে তাকে অতীতের মতো আগামীতেও সবসময় সামনের সারিতে পাওয়া যাবে বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।

মো. শাহিনুর রহমান : উপ-উপাচার্য এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

লিঙ্ক: দেশরূপান্তর  | ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০

আরও পড়ুন