জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সমকালীন বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। তিনি এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা ও প্রেক্ষাপটে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, যখন পৃথিবীব্যাপী উপনিবেশগুলোকে অবমুক্ত (decolonization) করার জন্য জনমত গঠিত হচ্ছিল। বিশ্ব ব্যবস্থায় উপনিবেশবাদ তখনও বহাল ছিল। হাতে গোণা কয়েকটি পশ্চিমা দেশ প্রায় সমগ্র পৃথিবীকে এক সময়ে শাসন ও শোষণ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ১৯৪১ সালের আগস্টে আটলান্টিক কনফারেন্সে পৃথিবীর সকল মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেন। যুদ্ধের পর পৃথিবীব্যাপী উপনিবেশগুলোকে অবমুক্ত (decolonization) করার জন্য ব্যাপক জনমত গঠিত হয়। পরবর্তীকালে এই অধিকার ইউএন চার্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়ার বিষয়ে জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে। কিছু দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল তারও পড়ে। উল্লেখ্য, সমগ্র আমেরিকা ‘এনলাইটেনমেন্ট’ (Enlightenment) আর ‘ক্রেওল জাতিয়তাবাদ’ (Creole Nationalism) এর কারণে উনিশ শতকেই উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে।
শাসনের নামে পাকিস্তানী গোষ্ঠী বাঙালির উপর যে শোষণ চালিয়েছিল, তার বিপরীতে বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন স্তর পার হয়ে বাঙালি জাতি ছয় দফার মতো ঐতিহাসিক মাইল ফলকে উপনীত হয়েছিল। এই মাইল ফলকের পরই পিতার নেতৃত্বে সংগ্রামী জাতি স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনিত হয়। ছয়দফা সহ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ই অনন্য। পৃথিবীর খুব কম জাতিরই এই রকমের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ছয় দফা ছিল একটি জাতির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে প্রেক্ষাপট নির্মাণ।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে পেট্রিশিয়ানদের বিরুদ্ধে প্লেবিয়ানদের সংগ্রাম, ইংল্যান্ডের ম্যাগনা কার্টা, ফরাসী বিপ্লবের মূলমন্ত্র, আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রাম ও পরবর্তীকালের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট আর পৃথিবীর দেশে দেশে উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম- এই সকল কিছু বঙ্গবন্ধুকে এই ছয় দফা প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর উদ্বুদ্ধ করেছিল এ দেশের কৃষক, শ্রমিকসহ সকল মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ, এদেশের সকল পেশাজীবি মানুষ। অন্যদিকে, পৃথিবীর স্বাধীনতা কামী অনেক জনগোষ্ঠী এই ছয় দফা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ছয় দফা শুধু আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবেই কাজ করেনি, স্বাধীন বাংলাদেশের অবয়ব কী রকম হবে, বাঙালি জাতির ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে বঙ্গবন্ধু কী রকমের রাষ্ট্র দেখতে চেয়েছিলেন, তারও একটি দিক নির্দেশনা আছে এই ছয় দফায়। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানে। স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকারের অধ্যায়সহ আমাদের সংবিধানের অন্যান্য অংশে এই ছয় দফার আদর্শের প্রতিফলন রয়েছে। বঙ্গবন্ধু মানুষে মানুষে সকল ধরণের বৈষম্য, বঞ্চনা ও শোষণ নির্মূল করার লক্ষ্যে যথাযথ সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীন দেশে যাতে উপনিবেশিক আমলের শোষণ অব্যাহত না থাকে সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলদেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বহুজাতিক কোম্পানির ইজারাভিত্তিক মালিকানা সাংবিধানিক বিধানের মাধ্যমে রহিত করেন। দেশের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার এই সাংবিধানিক অঙ্গিকার আমরা বঙ্গবন্ধু প্রনীত ছয় দফার মাধ্যমে পেয়েছিলাম।
মোটা দাগে বলতে গেলে, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭০ এর নির্বাচন, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র ও ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে লেখা আমাদের সংবিধানে এই ছয় দফার অনুপ্রেরনা রয়েছে।
পৃথিবীর খুব কম জাতিরই এই রকমের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। অথচ, পচাত্তরের পর অসাংবিধানিক ও অবৈধ সরকারগুলো ছয় দফাসহ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অধ্যায় কে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান থেকে অবৈধভাবে মুছে ফেলেছিল। তারা সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কথা এবং এর স্বীকৃতি বাতিল করেছিল। পৃথিবীর সাংবিধানিক ইতিহাসে এ রকম ঘৃণ্যতম রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বিতীয় আর দেখা যায় নি। পঁচাত্তর থেকে স্বাধীনতার মহান আদর্শবিরোধী যে শক্তি আমাদের উপর চেপে বসেছিল, তারাই এটি করেছিল। তারা একদিকে মহান মুক্তি সংগ্রামের সাংবিধানিক সীকৃতি বাতিল করেছিল, অন্যদিকে এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস জানতে না পারে সেজন্য সেই ইতিহাস তারা মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তারা বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার কথা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলেছিল, আর নিষিদ্ধ করেছিল ছয় দফার প্রবক্তা বাঙালি জাতির পিতা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ছয় দফাসহ মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস সাময়িক সময়ের জন্য মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে ছয় দফার ইতিহাস চির অম্লান থাকবে। আর ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেরাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
লেখক ড. সেলিম মাহমুদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
লেখাটি সারাবাংলায় প্রকাশিত: লিঙ্ক