বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে রক্ষা করতে সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। বিচারক গোলাম রসুল তার রায়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে এক্ষেত্রে মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, বিশেষ করে যারা ঢাকায় ছিলেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি, এমনকি পালনের কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেননি। তার মতে, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য এটি ‘চিরস্থায়ী কলঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের হত্যার বিচারে বিচারক গোলাম রসুলের এরূপ অবস্থানের প্রেক্ষিতে এও বলা প্রয়োজন যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তার মুখ্য নিরাপত্তা অফিসার মহিউদ্দিন আহমেদ, তার বাসায় কর্মরত হত্যার চাক্ষুস দর্শক পুলিশ অফিসার নুরুল ইসলাম খান (সাক্ষী ৫০) কিংবা তার ব্যক্তিগত অফিসারবৃন্দ খুনের পর এজাহার দিতে এগিয়ে আসেনি। আইন অনুযায়ী খুন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন ঢাকা নগরের পুলিশ সুপার, ঢাকা জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের মহাপরিদর্শক বা স্বরাষ্ট্র সচিব বঙ্গবন্ধুর বিদিত হত্যার বিষয়ে কোন প্রতিকার বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। অবশ্য ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দীন আহমেদকে (বীরবিক্রম) বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পরই সামরিক জান্তা গ্রেফতার ও চাকরিচ্যুত করে। বেশ সময় থেকে হয়ে আসা হত্যার ষড়যন্ত্র বিষয়ে কোন প্রাকভাষ বা তথ্য দিতে তেমনি ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের বিশেষ বিভাগ ও সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানগণ। ফলত হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পর এদের চেয়ে নিম্নতর পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলামকেই এগিয়ে এসে এজাহার দিতে হয়েছিল। দৃশ্যত একমাত্র মাহবুবউদ্দীন (বীরবিক্রম) ছাড়া অফিসারসুলভ সাহসের অনুপস্থিতি এসব অফিসারের ক্ষেত্রেও চিরস্থায়ী কলঙ্কের তিলক হয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত সকল অফিসারদের স্মর্তব্য থাকবে।
চার, রাষ্ট্রপক্ষের তরফ হতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। তাকে সহায়তা করেন তার সুযোগ্য পুত্র এই সময়ের আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের পরের দিকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ও আনিসুল হক উচ্চতর আদালতে হত্যা মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পান। ২০০২-এ এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক মারা যান এবং ২০০৩-এ এ্যাডভোকেট আনিসুল হক খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কালের বৈরী পরিবেশের কারণে জেলহত্যা মামলার সরকারী আইনবিদ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে এরূপ বিচার প্রতিকূল বৈরী পরিবেশ যারা সৃষ্টি করেছিল, নিঃসন্দেহে তারা আইনের যথার্থ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছিল। এদের স্বরূপ উদঘাটন করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের হত্যা মামলায় আসামি পক্ষে প্রধান আইনবিদের ভূমিকা নেয় এ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান। তার সঙ্গে ছিল সর্বএ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক, টিএম আকবর, নজরুল ইসলাম ও শরফউদ্দিন মুকুল। জোট সরকারের শাসনামলে (২০০২-২০০৮) আবদুর রাজ্জাক খান অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেলের এবং খান সাইফুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহ পরিবীক্ষণ করার সেলের আইনী উপদেষ্টার পদ লাভ করে। এসব তাৎপর্যপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক উদঘাটিত তথ্য অনুগমন করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ফলে যারা লাভবান হয়েছিল এবং এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় যারা ইচ্ছা করে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি বা অহেতুক প্রলম্বন কিংবা হত্যাকারীদের সুরক্ষা ও প্রতিপালনে সক্রিয় ছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন। দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করতে যে বা যারা ভূমিকা রেখেছিল, বিশেষত এই লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের আইনী খসড়া তৈরির দায়িত্ব বা কর্মকর্তার ভূমিকায় থেকে এই অধ্যাদেশটির খসড়া যে বা যারা তৈরি করেছিল, তা সংসদ কর্তৃক পাস করানোর মন্ত্রণা দিয়েছিল এবং সংসদে যারা বিনাবাক্যে দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে সমর্থন করেছিল আর ফলত এই সব হত্যার বিচার বন্ধ রাখার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, তাদের স্বরূপ এই দেশে ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ স্থাপনের স্বার্থে বের করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার আদল অনুযায়ী একটি সত্য (ট্রুথ) কমিশন প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে। কেবল শাস্তি আরোপন নয়, প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনের মাধ্যমে সামাজিক আত্মশুদ্ধির অবকাশ এ ধরনের পদক্ষেপ জাতিকে দেবে বলে আশা করা যায়।
’৯৮-এর ৮ নবেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। তিনি অপরাধীদের কৃত হত্যার নৃশংসতার আলোকে একটি ফায়ারিং স্কোয়াড দিয়ে প্রকাশ্যে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ মোতাবেক ফায়ারিং স্কোয়াড দিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করতে কোন অসুবিধার কারণ থাকলে প্রচলিত নিয়মানুসারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের প্রত্যেকের মৃত্যুদ- কার্যকর করতে হবে বলে তিনি সিদ্ধান্ত দেন। উল্লেখ্য, সামরিক আইনের বাইরে দেশের প্রচলিত বেসামরিক আইন অনুযায়ী ফায়ারিং স্কোয়াড দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কোন বিধান নেই।
বিচারক গোলাম রসুল ’৯৮-এর ১১ নবেম্বরে এই রায় মোতাবেক ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী বিচারে আরোপিত মৃত্যুদ- অনুমোদনের জন্য রায়ের অনুলিপিসহ নথিটি সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে অবিলম্বে পাঠানোর আদেশ দেন। অবিলম্বে পাঠানোর নির্দেশ সত্ত্বেও নথিটি হাইকোর্ট ডিভিশনে পাঠাতে ও যথা অবয়বে উপস্থাপন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ১ বছরের চেয়ে বেশি সময় লাগে। হাইকোর্ট ডিভিশনে বিচারপতি মোঃ রহুল আমীন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বেঞ্চে ’৯৮ সালের ৩০ নং ডেথ রেফারেন্স হিসেবে জেলা ও দায়রা আদালতের রায়ে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলা উত্থাপিত হয়। এই দুই বিচারপতি ৬৩ কর্মদিবসে মামলাটির শুনানি গ্রহণ করে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাদের সিদ্ধান্ত দেন। সুপ্রীমকোর্টের ইতিহাসে অন্য কোন ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিকরণে এত সময় লাগেনি। দীর্ঘতম সময় প্রযুক্ত করা সত্ত্বেও এই বিষয়ে দু’জন বিচারপতির দু’রকম সিদ্ধান্ত হয়। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (১) উত্থাপিত বিষয়টির বিভিন্ন দিকের আইনী অবস্থান বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা, (২) ১৫ জন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণাদি বিবেচনা এবং (৩) ৩ জন আসামির দোষ স্বীকৃতিমূলক বিবৃতি নিরিখ করে সর্বাত্মক আইনী দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের ওপর জেলা ও দায়রা বিচারক কাজী গোলাম রসুল আরোপিত দণ্ড বহাল রাখেন। নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিমূলক ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি কেন্দ্রিক কোন অসঙ্গতি বা অপূর্ণাঙ্গতা বা অগ্রহণীয় যুক্তি প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করার কোন কারণ তিনি খুঁজে পাননি বলে তার রায়ে উল্লিখিত হয় । বিচারপতি মোঃ রহুল আমীন একই তারিখের রায়ে বিচারক গোলাম রসুল কর্তৃক দ-িত ৯ জন আসামি, নামত (১) লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, (২) লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, (৩) লেঃ কর্নেল খোন্দকার আব্দুর রশীদ, (৪) মেজর মোঃ বজলুল হুদা, (৫) লেঃ কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, (৬) লেঃ কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, (৭) লেঃ কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), (৮) লেঃ কর্নের এমএইচবিএম নূর চৌধুরী এবং (৯) লেঃ কর্নেল মোঃ আবদুল আজিজ পাশার ওপর দ-বিধির ১০২খ এবং ৩০২/৩৪ ধারা অনুযায়ী আরোপিত মৃত্যুদণ্ড দৃঢ়ীকৃত করেন। আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ক্ষেত্রে তিনি দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় আরোপিত দণ্ড থেকে তাকে রেহাই দেন, কিন্তু দণ্ডবিধির ১২০খ ধারায় আরোপিত মৃত্যুদণ্ড দৃঢ়ীকৃত করেন। তার রায়ে অপর্যাপ্ত প্রমাণের কারণে তিনি আসামি (১) লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), (২) মেজর আহমদ শরফুল হোসেন, (৩) ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, (৪) ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ও (৫) রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেন। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির সমকালীন উন্নত পর্যায় বিবেচনায় না নিয়ে তিনি সাক্ষ্য হিসেবে কর্নেল রশীদ ও মেজর ফারুকের দম্ভোক্তি ও স্বীকারোক্তি হিসেবে অডিও ক্যাসেট ও তাতে প্রদর্শিত ও বিবৃত তথ্যাদি বিচারীয় উপকরণ হিসেবে গ্রহণীয় নয় বলে সাব্যস্ত করেন (অনুচ্ছেদ ৬০৫-৬০৭)। ফলত শেষোক্ত ৫ জন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছাড়া উপরোক্ত বাকি ৯ জন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মৃত্যুদণ্ড সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক দৃঢ়ীকৃত বলে গণ্য হয় ।
ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর: সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য
পর্ব: ০৪
সূত্র: লিঙ্ক