৭১-এ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বিস্মৃত কিছু গান

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

শোন একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি

আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ॥

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও গানের এই কথাগুলো আমাদের শিহরিত করে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধায় নতজানু হতে অনুপ্রাণিত করে। এখনো বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাকেন্দ্রিক জাতীয় দিবস ছাড়াও গানটি বিভিন্ন সময়ে এপার-ওপার বাংলায় প্রায়ই বাজে। তাই সবার কানে এটি খুব চিরচেনা একটি গান। গানটি শোনেননি এমন মানুষ দেশের মাটিতে বোধকরি খুব কমই। যতটুকু জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন লেখা এটিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুরারোপসহ গীত ও রেকর্ড করা প্রথম গান। গানের কথা লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী অংশুমান রায় আর সংগীত পরিচালনা করেছেন দিনেন্দ্র চৌধুরী। গানটি আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রথম প্রচারিত হয় ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ (শিল্পী অংশুমান রায়ের ডায়েরির পাতায় তারিখ লেখার ঘষামাজায় ১৫ এপ্রিল ১৯৭১-ও মনে হতে পারে)। পরে ২২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে গানটি রেকর্ড করে গ্রামোফোন কোম্পানি হিন্দুস্তান রেকর্ড (এসএলএইচ-১৮৩)। গানটি এসপি রেকর্ড হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় একটা বিপত্তি বাধে। এসপি রেকর্ডের দুই পৃষ্ঠায় একটি করে দুটি গান থাকে। এই গানটি রেকর্ড হলো, তাহলে অপর পৃষ্ঠায় কোন গান হবে এটি নিয়ে বাধল সমস্যা। যদিও সঙ্গে সঙ্গেই এর সমাধান করে দিলেন গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তিনি গানের কথা ও সুর ঠিক রেখে শুধু ভাষাটা ইংরেজি করে দিলেন। ফলে একই গানের একটি ইংরেজি ভার্সন তৈরি হলো। সেই গানে শিল্পী অংশুমান রায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠ মেলালেন শিল্পী কাবেরী নাথ। উল্লেখ্য, গানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ভাষণের ওপর ভিত্তি করে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার রচনা করেছিলেন। গানটির ইংরেজি ভার্সন এখন আর শোনা যায় না বললেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যম বা ব্যক্তিপর্যায়েও ইংরেজি ভার্সনের কোনো হদিস মেলেনি।

বছর কয়েক আগের কথা। একই গ্রামোফোন কোম্পানি হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আরেকটি গানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গান হিসেবে দাবি করা হয়। গানের শিরোনাম ‘জয় বাংলা’ (হিন্দুস্তান রেকর্ড : এসএলএইচ-১৭৭)। গানটি লিখেছেন লক্ষ্মীকান্ত রায়, সুর করেছেন প্রার্থনা মুখোপাধ্যায় আর গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী দীপেন মুখোপাধ্যায়। দাবিটি করেছেন গানের গীতিকার লক্ষ্মীকান্ত রায় নিজে, ইউটিউবে একটি ভিডিও বার্তায় এবং বাংলাদেশের সব সাংবাদিকের উদ্দেশে তার নিজ নামাঙ্কিত প্যাডের পাতায় লেখা একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি জানান, গানটি লেখার আটাশ দিন পর অংশুমান রায়ের ‘শোন একটি মুজিবের থেকে’ গানটি লেখা ও রেকর্ড করা হয়েছিল। অথচ তার গানটিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। লক্ষ্মীকান্ত রায় ইউটিউব ভিডিওবার্তায় জানান, তার লেখা গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পরই শেখ মুজিবুর রহমানের দুই মেয়ের উপস্থিতিতে তদানীন্তন বাংলাদেশ হাইকমিশনার হোসেন আলীর হাতে সেই রেকর্ডের কপি তিনি নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ৭৭ বছর বয়সে নিজে হাতে চিঠি লিখে তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে জানান, তিনি তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী নজরুল ইসলামসহ তাজউদ্দীনের কাছেও পৌঁছে দিয়েছিলেন তার লেখা গানের রেকর্ডটি। এমনকি ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচারিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ তার এই গান নিয়মিত প্রচারও করেছে। অথচ ‘জয় বাংলা’ গানটির কোনো স্বীকৃতি তিনি আজ পর্যন্ত পাননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিসত্তার মহানায়ক, বাংলাদেশের জাতির পিতা। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ তাকে সত্তরের দশকে দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। একাত্তরের ৭ মার্চ ভাষণের পর এপার বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত, তখন ওপার বাংলা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা জানিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশের থাকার প্রত্যয়ে অবিচল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, প্রচারিত হতে থাকে যুদ্ধের খবরাখবর, পাশাপাশি মুক্তিসেনাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে নানা আঙ্গিকে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত ভাষায় রচিত হয় গান। বাংলাদেশে সেই গানগুলো রেকর্ড করা হয় ‘ঢাকা রেকর্ড’ কোম্পানি থেকে। একই সঙ্গে কলকাতা থেকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এগিয়ে আসে এইচএমভি গ্রামোফোন কোম্পানি। একাত্তর সালের জুন মাসে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান তৈরির জন্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের অনুরোধ জানায়। বাংলা গানের নামিদামি শিল্পী, সুরকার, গীতিকাররাও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মীরাদেব বর্মণ, সুবীর হাজরা, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, অমিতাভ নাহা, বিশ্বনাথ দাস, পবিত্র মিত্রের মতো গীতিকাররা গান লিখেছেন। সুরকাররাও প্রাণবন্ত এবং আবেগপূর্ণ সুর করেছিলেন। এর মধ্যে শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রাহুল দেববর্মণ, বাপ্পী লাহিড়ী, অপরেশ লাহিড়ী, নীতা সেন, দীনেন্দ্র চৌধুরী, অভিজিৎ, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখ সুর দিয়েছেন। আর এদের ছাপিয়ে যেন প্রজ¦লিত হয়েছিলেন যুদ্ধজয়ের গানে সলিল চৌধুরী। গণসংগীতের মূর্ছনায় তিনি ছিলেন অন্যরকম দিশারি। গেয়েছেন কলকাতার অনেক শিল্পীই। হেমন্ত, দ্বিজেন, শ্যামল, মানবেন্দ্র, সত্যব্রত দত্ত, ভূপেন হাজারিকা, বনশ্রী সেন গুপ্ত, নির্মলা মিশ্র, আশা ভোঁসলে, রাহুল দেববর্মণ, দেবব্রত বিশ্বাস, ললিতা ধর চৌধুরী, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, অংশুমান রায়, কাবেরী নাথ, দীপেন মুখোপাধ্যায়, দ্বীপের বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদ্বকাশ চাকী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মিন্টু দাশ গুপ্ত প্রমুখ গেয়েছেন। এ ছাড়া রবিশংকরও এইচএমভি থেকে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে রেকর্ড করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ নামে একটি এলপি ডিস্ক।

হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে সে সময় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে অনেক গান রেকর্ড করা হয়। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুধু শিল্পী অংশুমান রায়ের গাওয়া, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটিই প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলকাতার শিল্পীদের প্রকাশিত গানের অন্যান্য রেকর্ড বাজানো হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যেসব গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানো হয়েছে, তা ঢাকায় উৎপাদিত ছিল। তবে কেবল বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে, শ্যামল গুপ্তের লেখা এবং আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘হাজার বছর পরে’ এবং ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম’ গান দুটি বাজানো হয়েছিল। যার প্রকাশক ছিল হিন্দুস্তান রেকর্ড (এসএলএইচ-১৯০)।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কলকাতার বিভিন্ন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রকাশিত অন্য গানের রেকর্ডগুলো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। অথবা সংরক্ষণ করা গেলেও, লক্ষ করা যায়, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর আজ পর্যন্ত এই গানগুলো বাংলাদেশের মাটিতে আর বাজেনি। ধারণা করা হয়, গানগুলোর মূল রেকর্ড সরকারি বা ব্যক্তি সংগ্রাহকের সংরক্ষণেও নেই। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, ৭৫-এরপর একটি কুচক্রীমহল দ্বারা বঙ্গবন্ধুসংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে, হয়তো সে কারণেই ৭১-এর সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বহুসংখ্যক গান হারিয়ে গেছে, যার মূল রেকর্ড আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ৭১-এর অসংখ্য কালজয়ী গান দেশের আনাচে-কানাচে থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন বই ও গবেষণায় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ৭১-এর অনেক গান, এখন পর্যন্ত কোনো বই বা গবেষণায় স্থান পায়নি। তাই ধরে নেওয়া যায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এই গানগুলো ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।

আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও গানে ঠাকুরবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। সে সাহিত্য ও গান বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ যেমন করেছে, তেমনি বিশ^দরবারে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। যদি গানের কথায় আসি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, বোন স্বর্ণকুমারী দেবী সবাই গান লিখেছেন। ধ্রুপদ-ধামারে বাংলা কথা বসিয়ে গান লিখেছেন তাদের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তাদের অনুসরণ করেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি দিনেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে ইন্দিরা দেবী, রবীন্দ্রনাথের আরেক ভাই বীরেন্দ্রনাথের ছেলে বলেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা দেবী, হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে প্রতিভা দেবীসহ ঠাকুরবাড়ির আরও কয়েকজন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লেখা হয়েছে ঠাকুরবাড়ি থেকে এবং তা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৭১ সালে, হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে এমনটা শুনলে যে কেউ চমকে যেতে পারেন। এবার গল্পটা জানা যাক।

রবীন্দ্র ও গণসংগীতের রাজা জর্জ বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘জর্জ কাকা’ আমাদের কাছে মূলত তার পোশাকি নাম তিনি কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তার কোনো সাংগঠনিক বা সাংগীতিক তৎপরতার বিবরণ পাওয়া না গেলেও ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ হওয়াকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে পার্টির চিন্তার বিপরীতেই ছিল তার উপলব্ধি। এ ব্যাপারে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সহকর্মীদের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘যে পূর্ববঙ্গের মাটিতে (কিশোরগঞ্জ জেলা) আমার জন্ম হয়েছিল, যে পূর্ববঙ্গে আমি শিশুকাল থেকে বড় হয়েছি, যে পূর্ববঙ্গে আমার নিজের ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন রয়েছে, সেই পূর্ববঙ্গ এখন আর আমার স্বদেশ নয় তা হয়ে গেল বিদেশ এতে আমার মন একেবারে ভেঙে পড়েছে।’ দেশ ভাগের পর এই যোগাযোগ যত ক্ষীণই থাকুক, নিজের দেশ আর মানুষকে তিনি ভুলে যাননি কখনোই। তার বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ঐকান্তিক অংশগ্রহণে।

তার রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সঙ্গে ১৯৬৯ সাল থেকে চলে আসা বিরোধের কারণে তিনি ১৯৭১-৭২ সালের পর আর কোনো রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেননি। কিন্তু তাতে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তার সখ্য ম্রিয়মাণ হয়নি। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সন্তান। সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চিরকাল ঠাকুর পরিবারের ব্যতিক্রমী পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন তিনি। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বাঙালি হিসেবে সৌমেন্দ্রনাথ সমধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দেবব্রত বিশ্বাস সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি চিঠিতে লিখে জানান, ‘তার জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বাংলাদেশের তার ভাই-বোনরা জীবনমরণপণে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই লড়াইকে তিনি (সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) সমর্থন করেন কি না…। যদি সেই লড়াইয়ের প্রতি তার সামান্য একটু সমর্থন থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে দুটি গান লিখে তাকে (দেবব্রত বিশ্বাস) পাঠাতে অনুরোধ জানান। দেবব্রতের চিঠির ভাষায়, ‘যাতে সেই গান দুটির রেকর্ড প্রকাশ করে এবং নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে এপার বাংলার জনসাধারণকে বাংলাদেশের আমার ভাই-বোনদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারি।’ এই চিঠি পাওয়ার পর সৌমেন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে বিশ্রামের জন্য বোম্বাই চলে যান এবং সেখান থেকে তার রচিত প্রথম গানটি স্বরলিপিসহ দেবব্রত বিশ্বাসকে ডাকযোগে পাঠান। কয়েক দিন পর তিনি কলকাতাতে ফিরে স্বরলিপিসহ দ্বিতীয় গানটিও ডাকযোগে পাঠান। এ সময় দেবব্রত বিশ্বাস নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হয়ে উঠেই তিনি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মতি নিয়ে গান দুটির কথা ও সুরে সামান্য পরিবর্তন করে গান দুটি রেকর্ড করেন। এই রেকর্ডটিও প্রকাশ করে হিন্দুস্তান রেকর্ড (এসএলএইচ-১৯০)। তার একটি গান,

ওই তারা চলে দলে দলে মুক্তি পতাকাতলে

পরাধীনতার কারা ধূলিতে মিশায় তারা,

হাতে হাত দিয়ে প্রাণে প্রাণ মিশে,

মুক্তিবাহিনী চলে।

মুক্তিবাহিনী নাশিছে শত্রু, বাংলার হবে জয়

স্বাধীন হইবে বাংলার লোক, জয় বাংলার জয়

জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা।

শোনো বিপ্লব হুংকার বাংলার জনতার।

লক্ষ লোকের চলার আগুনে বাংলার পথ জ্বলে।

জর্জ বিশ্বাস (দেবব্রত বিশ্বাস) তার নিজের রেকর্ডের ব্যাপারে কতগুলো নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে রেকর্ডিং কোম্পানিকে বাধ্য করতেন; রেকর্ডের প্রচারের ব্যাপারে কোনো প্রচার চালানো যাবে না, কোনো পত্রিকায় রিভিউ করার জন্য পাঠানো যাবে না; এমনকি প্রথমদিকে তার কোনো ছবিও ছাপতে দিতেন না রেকর্ডের মোড়কে; কোম্পানির অনেক জোরাজুরিতে শেষে অবশ্য একটি ছবি দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গাওয়া গানের এই রেকর্ডটির ব্যাপারে তার বেঁধে দেওয়া এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন রেকর্ডটির প্রচারের ক্ষেত্রে। এই গানগুলো তিনি নিজেই প্রচার করে বেড়াতেন নানা স্থানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংগীতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, তার এই গান দুটি কোনো অজ্ঞাত কারণে মনে হয় এখন কিছুটা দুষ্প্রাপ্য ; তাই গান দুটি শোনা যায় না কোথাও। রেকর্ডের সংগ্রহও কারও কাছে সংরক্ষিত নেই।

আগরতলা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যারা পাক-হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র হাতে ময়দানে লড়াই করেননি, কিন্তু বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিলেন কবি, লেখক, সাহিত্যিক, গায়কসহ বুদ্ধিজীবী। এমনই একজন গীতিকার আগরতলার সুবিমল ভট্টাচার্য। ১৯৭১ সালে সুবিমল ভট্টাচার্যের বয়স ছিল ৩৩ বছর, তখনকার সময় সংবাদমাধ্যম বলতে খবরের কাগজ আর রেডিও। সেই রেডিওতে পাক-হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর দ্বারা নিরীহ তৎকালীন পূর্ববাংলার নিরীহ হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালি মানুষের ওপর অত্যাচারের খবর শোনা যেত। এসব খবর তিনি নিয়মিত শুনতেন আর মানসিকভাবে আহত হতেন। এ ধরনের অত্যাচারের খবর শুনে তিনি আগরতলায় বসে লিখলেন,

‘বুড়িগঙ্গা নদীরে, তোর বুকে আমি

ডিঙ্গা কেমনেরে ভাসাই,

পানি যে তোর রক্তে রাঙ্গা

বৈঠা কান্দে তাই’

গানটি কলকাতায় হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ড করা হয়। গানটি সে সময় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিছুদিনের মধ্যে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গানটি। এই গানের সাফল্য দেখে রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাকে আরও একটি গান লেখার অনুরোধ জানায়। তখন তিনি পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক গান লেখেন

(আরে) শোন শোন জগতবাসী, শোন মন দিয়া

বাংলাদেশে কীর্তি রাখলেন গোঁসাই ইয়াহিয়া।

পশ্চিম দেশের গোঁসাই ঠাকুর

কতই জানেন চাতুরী,

কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।

(আরে) দিবারাত্র বৈঠক করলেন

মুজিব ভাইয়ের শর্ত মানলেন। ও আহা বেশ!

আর তলে তলে ঢাকার পথে

নামাইলেন মিলিটারি।

কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।

(আরে) ঢাকা শহর ফাঁকা হইলো

লাখে রাখে জান মারিলো। ও আহা বেশ!

আর এরোপ্লেনে চইড়া গোঁসাই

চোরের মত দেন পাড়ি

কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।

স্কুল-কলেজ চুরমার করে

যুবতী পাইলে ধরে। ও আহা বেশ!

আর লালসা মিটাইয়া তাগো

পাঠায় রে যমের বাড়ি।

কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।

যুবক জোয়ান জ্যান্ত ধইরা

রক্ত শুষে মেশিন দিয়া। ও আহা বেশ!

রক্ত বোতল ভইরা ব্যাংকে জমায়

বাঁচাইতে মিলিটারি

কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।

এতো পাপ কইরা তোমার

উচিত শাস্তি হইলো এইবার

আহা! ইতিহাসের পাতায় তুমি

করলে খুনির নাম জারি

কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।

তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন তিনি রেডিওতে শুনতে পান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক আবদুল জব্বার, সহিদুল চৌধুরী, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়সহ বেশ কয়েকজন শিল্পী আগরতলায় শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আবদুল জব্বারসহ বাংলাদেশের অন্য শিল্পীদের কলকাতায় পাঠিয়ে হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। পরে এই সংস্থা থেকে আবদুল জব্বারসহ বাংলাদেশের অন্য শিল্পীদের মোট ২৮টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গান রেকর্ড হয়। সেই গানগুলোর মূল রেকর্ড এখন আর খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই শোনা যায় না কোথাও।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে গত দশ বছরে, এপার বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারের জন্য যেসব গান রেকর্ড করা হয়েছে, তার মোটামুটি একটা সংগ্রহ ও সংকলন করা গেছে, গ্রন্থভুক্তও করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওপার বাংলা (কলকাতা) থেকে প্রকাশিত তিনটি গান ছাড়া বাকি গানগুলো সংগ্রহ ও গ্রন্থভুক্ত করা যায়নি এখনো। জয় বাংলা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গান এখনো আমাদের শোনা হয়ে ওঠেনি, কারণ সেসব গানের মূল রেকর্ডগুলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিপর্যায়ে কারও সংগ্রহে নেই এমনটা ধারণা করা যায়। কিন্তু এই গানগুলোও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনন্য উপকরণ, বাস্তব দলিলও বটে। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা আমাদের ইতিহাসের প্রয়োজনেই অতীব জরুরি এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় আমাদের নেই।

লেখক তৌহিন হাসান : চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক ও শৌখিন সংগ্রাহক

touhinhasan@gmail.com গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রকাশিত।

লেখাটি দেশরূপান্তরে প্রকাশিত: লিঙ্ক

আরও পড়ুন