বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ॥ জাতির বিক্ষত বিবেক

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

২০০১ সালের ১০ অক্টোবর জোট সরকার ক্ষমতায় এসে আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক খানকে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল ও খান সাইফুর রহমানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ সেলের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করে। একই সময়ে জোট সরকার এই নৃশংস হত্যা মামলার সফল তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আখন্দকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। আবদুল কাহার আখন্দের তদন্তে তত্ত্বাবধায়ক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ অফিসার আবদুল হান্নান খান ২০০১ পরবর্তী বৈরী পরিবেশে চাকরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও পরবর্তীকালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মামলাটির প্রস্তুতি ও বিচার পূর্ব প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সমন্বয়ের দায়িত্ব আমি পালন করি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আমার অনুকূলে বরাদ্দ সরকারী বাড়ি এই প্রক্রিয়ায় সরকারের তরফ থেকে মামলা পরিচালনার দফতর হিসেবে আমি প্রযুক্ত করি। সম্ভবত এই কারণেই ২০০২ সালের ১৫ মার্চ জোট সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মোড়কে আমায় অন্তরীণ করে রাখে। ৮ মাস পরে সুপ্রীম কোর্ট আমার অন্তরীণাদেশ বেআইনী ঘোষণা করলে আমি মুক্তি পাই।

বিচার প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার পরিজন ও অন্যদের নির্মম হত্যাকা-ের বিবরণ, বাদী পক্ষের তরফ হতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির ভিত্তিতে আদালত কর্তৃক রেকর্ডকৃত হয়। এসব থেকে জানা যায় যে, ‘৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত ৮.৩০ মিনিটের দিকে বঙ্গবন্ধু তার প্রতিদিনের কাজ শেষে ধানম-ি (তখনকার) ৩২নং সড়কের রাষ্ট্রপতি ভবনে (প্লট নং ৬৬৭) ফিরে আসেন। রাত ৮টা থেকে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম (সাক্ষী ১) ধানম-ির রাষ্ট্রপতির ভবনে কর্তব্যরত ছিলেন। ভবনের নিচ তলায় তার সঙ্গে ছিলেন টেলিফোন মেকানিক আবদুল মতিন ও রাখাল ছেলে আবদুল আজিজ। দোতলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, ২ ছেলে জামাল ও রাসেল, জামালের সদ্য পরিণীতা স্ত্রী রোজী ও বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের। তিন তলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার সদ্য পরিণীতা স্ত্রী সুলতানা। দুই তলায় বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় শুয়ে আরও ছিলেন পরিচারক আবদুর রহমান ওরফে রমা (সাক্ষী ২) ও সেলিম ওরফে আবদুল (সাক্ষী ৩)। ভবনের পাহারায় সামরিক বাহিনীর সদস্য ছাড়াও অন্যদের মধ্যে সে সময় প্রযুক্ত ছিলেন ডেপুটি পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম খান (সাক্ষী ৫০)। রাত ১টার সময় (১৫ আগস্ট) মুহিতুল ইসলাম ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ৪.৩০ এর দিকে টেলিফোন মেকানিক মতিনকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুহিতুলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মন্ত্রী সেরনিয়াবাতের বাসভবনে হামলা হয়েছে বলে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে ফোনে জানাতে বলেন। বঙ্গবন্ধু সেরনিয়াবাতের বাসভবনে হামলার সংবাদ লালফোনে পেয়ে থাকবেন। মুহিতুল গণভবন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে সংযোগ পেতে ব্যর্থ হন। বঙ্গবন্ধু তখন দোতলা থেকে নেমে এসে মুহিতুলের হাত থেকে নিজে ফোন হাতে নেন। এমন সময় ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি মুহিতুলের অফিসের দক্ষিণ দেয়ালের কাঁচ ভেঙ্গে উত্তরের দেয়ালে লাগতে থাকে। এই সময় বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুলসহ ঘরের নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেন। গুলি আসার সময় রাষ্ট্রপতি ভবনে সেনাবাহিনী থেকে নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রযুক্ত কর্তব্যরত হাবিলদার মোঃ কুদ্দুস শিকদার (সাক্ষী ৪) যথারীতি বিউগল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যসব সহকর্মীসহ রাষ্ট্রপতির বাসভবনে (এখনকার ধানমন্ডি ৩২ সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু ভবন) জাতীয় পতাকা তুলছিলেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের পূর্ব দিকের বাড়িতে হাবিলদার কুদ্দুস ও রাষ্ট্রপতি ভবনের নিরাপত্তায় প্রযুক্ত অন্যসব সেনা সদস্য থাকতেন। তারা বিভাজিত কর্তব্য অনুযায়ী পালাক্রমে ভবনটি পাহারা দিতেন। ঐ বাড়ীতে অবস্থানরত সেনা প্রহরীদের কাছ থেকে তাদের কাছে দেয়া গোলাবারুদ এর আগে সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদার ওগুলোর পরিবর্তে নতুন গোলাবারুদ দেবে বলে নিয়ে নেয়। ফলে গোলাবারুদবিহীন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত সেনা প্রহরীরা হামলাকারীদের প্রতিকূলে নিক্রিয় ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। খানিক পরে গুলি থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি ধরে দোতালায় উঠে যান। গুলি থামার পর পরই কালো ও খাকি পোশাকধারী সেনাবাহিনীর লোকজন ভবনের গেট দিয়ে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলতে বলতে ভবন প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। পাহারায় প্রযুক্ত গোলাবারুদবিহীন সেনা সদস্য ও হালকা অস্ত্রের পুলিশ তাদেরকে তেমন কোন বাধা দেয়নি বা দিতে পারেনি। এ সময় ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর নূর এবং মেজর মহিউদ্দিনকে (লান্সার) ভবনের গেটে দেখা যায় (এই সময় এই অফিসারদের এসব পদবী ছিল। বঙ্গন্ধুর হত্যার পর জিয়াউর রহমান কর্তৃক তাদের পদবীর উন্নয়ন হয়)। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর ভবনের নিচতলার বারন্দায় উঠে এসে শেখ কামালকে মুহিতুলের অফিস ঘরে দেখতে পায়। শেখ কামাল বঙ্গবন্ধু দোতলায় উঠে যাওয়ার পর পরই নিচতলায় নেমে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা শেখ কামালকে স্টেনগান দিয়ে পর পর দু’বার গুলি করে হত্যা করে। এরপর ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর মহিউদ্দিন (লান্সার) ভবনে উপস্থিত পুলিশ ও বেসামরিক ব্যক্তিদের গেটের সামনে লাইন করে দাঁড় করায়। লাইনে দাঁড় করানো এসব ব্যক্তির মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রযুক্ত পুলিশবাহিনী প্রধান ডেপুটি পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম খানও ছিলেন। তার সঙ্গে দাঁড়ানো বিশেষ শাখা বা এসবি পুলিশের এসআই সিদ্দিকুর রহমান গুলিবদ্ধ হয়ে মারা যান। লাইনে দাঁড়ানো কিংবা লাইনের বাইরে এ সময়ের আগে বা পরে হামলাকারী সেনাদের গুলিতে পুলিশের ডেপুটি সুপার নুরুল ইসলাম, ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম ও পরিচারক সেলিম গুলিবদ্ধ হয়ে আহত হন। এরপর মেজর মহিউদ্দিন (লান্সার) তার সঙ্গের সিপাহীদেরসহ গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভবনের দোতলায় উঠে যায়। একই সময়ে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর কতিপয় সিপাহীসহ হাবিলদার কুদ্দুস শিকদারকে (সাক্ষী ৪) জোর করে পেছনে নিয়ে দোতালায় ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মেজর মহিউদ্দিন (লান্সার) নিচে নামার জন্য এগিয়ে এলে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন ‘তোরা কি চাস’? বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর স্টেনগান দিয়ে তাকে গুলি করে। গুলি খেয়ে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে পড়ে যান এবং প্রাণ ত্যাগ করেন।

বঙ্গবন্ধুকে এভাবে হত্যা করার পর মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও অন্যরা নিচে নেমে এসে গেট দিয়ে ভবনের দক্ষিণে (৩২নং) সড়কে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং ১ম বেঙ্গল লান্সার ইউনিট ও ২ ফিল্ড আর্টিলারীর সিপাহীরা গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। এরপর মেজর আজিজ পাশা তার সিপাহীদের নিয়ে ভবনের দোতলায় ওঠে। হাবিলদার কুদ্দুস শিকদার (সাক্ষী ৪) তাদের নির্দেশ অনুযায়ী পেছনে পেছনে যান। সেখানে তিনি সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদারকে (আসামি) দেখতে পান। সুবেদার মেজর জোয়ারদার ঐদিন ভোর পৌনে ৫টায় সেনাবাহিনীর জীপ নিয়ে (তখনকার) রাষ্ট্রপতি ভবনে কর্মরত সৈনিকদের বেতনাদি দিতে এসেছিল। মেজর আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের বন্ধ দরোজায় গুলি করে ভেতরের লোকজনকে তা খুলতে বলে। তখন বেগম মুজিব দরোজা খুলে ঘরের ভেতরের লোকজনকে গুলি না করতে অনুরোধ ও অনুনয় করেন। সেনা সদস্যরা শোবার ঘরে থেকে বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও পরিচারক রমাকে (সাক্ষী ২) বের করে আনে। বেগম মুজিব সিঁড়ির কাছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এর পর বেগম মুজিবকে তারা শোবার ঘরে নিয়ে তাকে সামনে রেখে শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে নিচের তলায় নিয়ে যায়। এই সময় হাবিলদার মোসলেম উদ্দিনের হাত থেকে স্টেনগান নিয়ে মেজর আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকারীরা এরপর নিচের তলায় নেমে আসে। কুদ্দুস শিকদার (সাক্ষী ৪) তাদের পেছনে নিচে নেমে এসে শেখ নাসেরকে অভ্যর্থনা ঘরের সঙ্গে লাগোয়া গোসলখানায় মৃত দেখতে পান। একজন অস্ত্রধারী সেনা এর আগে তাকে গোসলখানায় নিয়ে গুলি করে। এরপর মেজর আজিজ পাশা গেটের বাইরে গিয়ে বেতারে বা ওয়ারল্যাসে কথা বলে ভেতরে এসে শেখ রাসেলকে দেখতে পায়। শিশু শেখ রাসেল তখন কাঁদতে কাঁদতে মার কাছে যাওয়ার কথা বলে। তখন মেজর আজিজ পাশা ১ম বেঙ্গল লান্সার ইউনিটের একজন হাবিলদারকে দিয়ে শেখ রাসেলকে দোতলায় পাঠিয়ে দেয়। এর পর হাবিলদার কুদ্দুস দোতলা থেকে গুলির ও কান্নার শব্দ শোনে। যে হাবিলদার শেখ রাসেলকে নিয়ে ওপর তলায় গিয়েছিল সে এরপর নেমে এসে গেটের সামনে মেজর আজিজ পাশার কাছে সব শেষ হয়েছে বলেই রিপোর্ট করে (সাক্ষী ৪ হাবিলদার কুদ্দুস শিকদার ও সাক্ষী ৫০ নুরুল ইসলাম খানের সাক্ষ্য)। এর পর একটি ট্যাঙ্কে চড়ে ভবনের গেটের সামনে মেজর ফারুক আসে। মেজর ফারুকের সঙ্গে মেজর আজিজ পাশা, মেজর নূর ও মেজর মহিউদ্দিন কথা বলে। কথা বলে মেজর ফারুক তার ট্যাঙ্ক নিয়ে চলে যায়।

এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করার নক্সায় মেজর ফারুকের দায়িত্ব ছিল ট্যাঙ্ক সহযোগে সাভারে অবস্থানরত রক্ষী বাহিনীকে রাষ্ট্রপতি ভবনে হামলার সময়ে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এগিয়ে না আসতে দেয়া। রক্ষীবাহিনীকে খুনীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত বাহিনী বলে ধরে নিয়েছিল। সকাল ৮টার দিকে সেনারা ১টি লাল গাড়িতে করে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব কর্নেল জামিলের মৃতদেহ নিয়ে ভবনের ভেতরে আসে। কর্নেল জামিল রাষ্ট্রপতির ভবনে হামলা ঠেকাতে এসে হামলাকারী সেনাদের হাতে সোবহানবাগ মসজিদ ও রাষ্ট্রপতি ভবনের মাঝখানে সড়কের কোন স্থানে নিহত হয়েছিলেন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর হামলাকারী সেনারা ভবনের মূল্যবান জিনিসপত্র তছনছ করে এবং তাদের কাঁধ-ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদারকে স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিতে দেখা যায়। সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদার এর আগে রাষ্ট্রপতি ভবনের নিরাপত্তায় প্রযুক্ত সেনা সদস্যদের কাছ থেকে তাদের অস্ত্রে ব্যবহার্য গুলিগুলো নতুন গুলি দেয়ার কথা বলে নিয়ে গিয়েছিল। ওহাব জোয়ারদার পুরনো গুলির বদলে নতুন গুলি পরে আর দেয়নি (সাক্ষী ৫ নায়েব সুবেদার গণির সাক্ষ্য)। হত্যাকা-ের পর ভবনের গেটে মেজর ফারুক মেজর শরিফুল হক ডালিমসহ ফিরে আসে। মেজর ফারুক ক্যাপ্টেন হুদাকে তখন মেজর পদের পদোন্নয়নমূলক শাপলা ফুলের এবং সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদারকে লেফটেন্যান্ট পদের পদোন্নয়নমূলক তারকা পরিয়ে দেয়। ’৭৫ এর ১৬ আগস্ট ভোরে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, বেগম মুজিব, শেখ নাসের, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমানসহ মোট ৯টি মৃতদেহ একটি গাড়িতে করে নিয়ে যায়। শেখ হাসিনা, তার স্বামী ড. ওয়াজেদ, ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুল এবং বোন শেখ রেহানা এই সময় দেশের বাইরে ছিলেন বলে এই নারকীয় হত্যার শিকার হননি। এস আই সিদ্দিকুর রহমানের লাশ বাদে বাকি লাশগুলো বনানী কবরস্থানে জানাজা ছাড়া দোয়া-দরুদ পরে কবরস্থ করা হয় (সাক্ষী ৪ হাবিলদার ক্দ্দুুস শিকদার, সাক্ষী ১০ মেজর জেনারেল আবদুর রব ও সাক্ষী ৩১ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষ্য)। এসআই সিদ্দিকুর রহমানের লাশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে জানাজার পর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। একই দিনে সকাল ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ একটি পিক আপে করে বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। বেলা ২টার সময় টুঙ্গিপাড়া থানার সামনে হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ নামানো হয়। গোপালগঞ্জের তখনকার মহকুমা পুলিশ অফিসার নুরুল আলম, আইনবিদ-ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদের ও সার্কেল ইন্সপেক্টর (পুলিশ) শেখ আবদুর রহমান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহের সঙ্গে আসা সেনারা তখনই বঙ্গবন্ধুকে দাফন করতে চেয়েছিল। স্থানীয় জনগণ গোসল, কাফন ও জানাজা ছাড়া তার মৃতদেহ দাফন করতে রাজি হননি। তখন স্থানীয় জনগণের মধ্যে আবদুল মনাফ, ইমানুদ্দিন, নুরুল হক শেখ ও কেরামত হাজী বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহকে গোসল করান। আবদুল হাই শেখ ও মৌলভী আবদুল হালিম কাফন বানিয়ে অন্যদের সহযোগিতায় তা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ আবৃত করেন। কাফনের জন্য স্থানীয় রেডক্রসের অফিস থেকে ৩টি সাদা শাড়ি ও গোসলের জন্য ওখানকার দোকান থেকে ২টি তিব্বত ৫৭০ বল সাবান এনে ব্যবহার করা হয়। কাফনের কাপড় ও গোসলের সাবান আনেন আবদুল হাই শেখ, রজ্জব আলী ও শেখ আবদুর রহমান (সার্কেল ইন্সপেক্টর)। সেনাদের বাঁধার মুখে ঐ সময়ে হাজার হাজার লোক উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর জানাজায় ২০/২৫ জনের বেশি লোক অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। জানাজায় ইমামতি করেন মৌলভী আবদুল হালিম শেখ। বঙ্গবন্ধুর পরনের কাপড় চোপড় আবদুল মান্নান শেখের কাছে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে তার মা-বাবার কবরের পশ্চিমে পাশে কবরস্থ করা হয় (সাক্ষী ২৮ আবদুল হাই শেখের সাক্ষ্য)।

এই নির্মম হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য ’৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর ফারুক ঢাকা বিমান বন্দরের পাশে বালুর ঘাটে, প্রশিক্ষণের মোড়কে সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ ও ক্ষমতা অভিলাষী কতিপয় অফিসারদের একত্রিত করে। এদের মধ্যে ছিল মেজর ফারুকের রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আহমদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন নুরল হক, ক্যাপ্টেন নকীব ও লেঃ কিসমত। বিমান বন্দর এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য একই সময়ে মোতায়েন মেজর রশীদ ও তার অধীনস্থ ২নং ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টের সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা মতো মেজর ফারুক যোগাযোগ করে। ১৫ আগস্ট রাত ১টার দিকে মেজর রশীদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর শাহরিয়ার ও মেজর বজলুল হুদা, ১ম বেঙ্গল লান্সার রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণকালীন সদরে মিলিত হওয়ার পর ঐ রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর ফারুক বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে অভিযান চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার পরিকল্পনা খুলে বলে (দ্রষ্টব্য, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত মেজর ফারুকের স্বীকারোক্তি)। মেজর ফারুক এই প্রসঙ্গে বলে যে, বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত না করলে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী উঠিয়ে দেয়া হবে। জাতি আবার অন্য দেশের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। এই পরিণতি পরিহার করে বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রুপান্তরিত করার জন্য খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর মহিউদ্দিন, মেজর বজলুল হুদা, মেজর আজিজ পাশা ও মেজর নূরকে ধানমন্ডির রাষ্ট্রপতির ভবন (তখনকার ৩২নং সড়কের ৬৬৭নং ভবন) হামলার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই হামলার জন্য ৬টি ৩ টন গাড়ি, গোলাবারুদসহ ১০০ ল্যান্সার সৈনিক ও ৫০ জন আর্টিলারির সৈনিক নিয়োগ করা হয়। তখনকার সময়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী তরুণ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনির ধানম-ির বাসায় হামলা (তখনকার ১৩/২ সড়কস্থিত) করে তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয় রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে (ল্যান্সার)।

এই নির্দেশ অনুযায়ী রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ল্যান্সার গ্রুপের কতিপয় সদস্যসহ শেখ মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজুকে তাদের ধানমন্ডির বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মোস্তফা ও ক্যাপ্টেন মাজেদকে মিন্টো রোডের মন্ত্রী সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা ও তাকে হত্যার জন্য নিয়োজিত করা হয়। মেজর শরিফুল হক ডালিমকে বাংলাদেশ বেতারের শাহবাগের অফিস দখল ও নিয়ন্ত্রণের ভার দেয়া হয় (দ্রষ্টব্য, লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ প্রদত্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার প্রদত্ত স্বীকারোক্তি)। এভাবে নিয়োজিত হয়ে ১৫ আগস্টের শেষ রাতে হামলা চালিয়ে তারা মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বাবু সেরনিয়াবাত ও শহীদ সেরনিয়াবাত ও অন্যদের হত্যা করে। বেগম সেরনিয়াবাত গুলিবিদ্ধ হয়ে শরীরে গুলি ও মনে দুঃসহ স্মৃতির ধারক হয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

পর্ব ০২

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ

আরও পড়ুন