কথা উঠেছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। একদল বলছে, শেখ মুজিব সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি; অন্তত বাংলার শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের একজন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘জাতির পিতা’ ও বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত মহানায়ক। তাঁরই সংগ্রামের উত্তাপ উপমহাদেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে হাজার বছরের পরবশ্যতার সমূহ গ্লানি মুছিয়ে দিয়ে একটি নবীন রাষ্ট্র সম্ভাবিত করেছে। সংগ্রামের অবিসংবাদিত মহানায়ক। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে তাঁর নাম ধ্বনিত হয়। বস্তুত, বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, বলাকা নয়, সোনারতরী নয়; ‘আর দাবায়ে রাখাবার পারবা না’। সহস্রাধিক বছরের পরাধীন জীবনের অস্তিত্বের প্রতি সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে এই উচ্চারণের মাধ্যমে গোটা জাতির চিত্তলোকে তিনি এমন একটা অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট এক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এ গৌরব শেখ মুজিবকে অবশ্যই দিতে হবে।
আরেক দল বলছে, শেখ মুজিবও কি একজন তেমন মানুষ, লাখো প্রদীপ জ্বালা স্তুতি নিনাদিত উৎসব মঞ্চের বেদিতলে সপরিবারে যার মরদেহ ঢাকা পড়ে রইল? রাজপথে শোকের মাতন উঠল না, ক্রন্দনধ্বনি আকাশে গিয়ে বিঁধল না, কোথাও বিদ্রোহ-বিক্ষোভের ঢেউ জলস্তম্ভের মতো ফুলে ফুলে জেগে উঠল না। এ কেমন মৃত্যু, এ কেমন পরিণতি শেখ মুজিবের সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের! সব চুপচাপ নিস্তব্ধ!
একটি সদুত্তর প্রয়োজন। কী ছিলেন শেখ মুজিব-বীর? একটা জবাব টেনে বের করে আনতে না পারলে বাংলার ভাবী ইতিহাসের গতিরেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে না। বারবার শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভূমিকাটি অনির্ণীত থেকে যাচ্ছে বলেই বাঙলি জাতির ইতিহাসের পরিক্রমণ ক্রমে ঝাপসা, অস্পষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। এই ঐতিহাসিক অলাতচক্র, যার মধ্যে দিনের আলোয় সবাই পথ হারায়, রাতে রাতকানা হয়ে থাকে।
শুধু শেখ মুজিব নন, ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে এবং যার গর্ভ থেকে বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তার চরিত্রটি নির্ণয় করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমান—এ দুটো যমজ শব্দ; একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিতপূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দুবার গণ আন্দোলন সৃজিত হয়েছিল, তার লক্ষ্যের অস্পষ্টতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি—এসব বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীর দাবিদাওয়ার মোড়ক; যা চিহ্নিত হয়েছিল বাঙালি, জাতীয়তাবাদের নামে; তাই নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে গোটা বাংলাদেশের জনমত তার সপক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে পর্যালোচনার কালে শেক্সপিয়রের উল্লিখিত পঙিক্তটি খুবই তাত্পর্যবহ বলে প্রতীয়মান হবে। মানুষ জীবন দিয়েই তো সবকিছু করে। তার কোনো কর্মই জীবন থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন নয়।
কিন্তু একটি জাতি আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করার তাগিদে বাংলার ইতিহাসের স্মরণকালের সবচেয়ে মহত্তম ও ব্যাপক জনযুদ্ধটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার বেগ-আবেগ সবটুকু ধারণ করেছিলেন শেখ মুজিব; অন্য কোনো নেতা নন। নিঃসন্দেহে সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এমন কিছু উর্বর উপাদান ছিল, যা শেখ মুজিবকে এ জাতির স্রষ্টা হতে সহায়তা করেছিল। ঘটনা ও সময়ের উত্তাপের মধ্যে আর্শ্চয সারবান কিছু উপাদান যেমন ছিল, এ মানুষটির মধ্যেও সেইসব ধারণ করার একটা ক্ষমতা ছিল।
একজন বা একাধিক ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটা রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে, কিন্তু আদর্শের মরণ নেই।
শেখ মুজিবুর রহমান এই জাতির মহান স্থপতি ও একজন মহান পুরুষ। সব দোষ-ত্রুটি রাজনৈতিক প্রমাদ ও সীমাবদ্ধতাসহ বিচার করলেও তিনি অনন্য। একজন মহান পুরুষ। শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান।
এখানে কার্ল মার্ক্সের একটি কথা আমি উদ্ধৃত না করে পারছি না। কোনো ডাকাত সর্দার কোনো সুযোগে রাজাকে হত্যা করলে ওই ডাকাত সর্দারের ওপর রাজ্য শাসনের অধিকার বর্তায় না। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যাকারীদের যুক্তিও অনেকটা ওই কথিত ডাকাত সর্দারের অনুরূপ।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র দমনের রূপকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে, জনগণের মধ্যে কোনো উত্থান শক্তি নেই, স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো একে একে ধুলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। জনজীবন ও সমাজ অপরাধের ভারে জর্জরিত এবং কলুষিত। বাংলার হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষ শেখ মুজিবর রহমানকে এই জাতির মহান স্রষ্টা হিসেবে জ্ঞান করবে। দিনের পর দিন যাবে, জনগণের অন্তঃলালিত এই শ্রদ্ধা ঘনীভূত হয়ে বিকশিত স্বর্ণের রূপ ধারণ করবে। হদয়ে চেপে বসবেন, কেউ ঠেকাতে পারবে না।
আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যার দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হূদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিক চিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোত্স্নারাতে রুপালি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তার ভালোবাসা। জানো, খোকা তার নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।
আতাউর রহমান: গবেষক