বিশ্ব অঙ্গনে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি শেখ রেহানার

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন জাতি যখন স্তম্ভিত, দিকনির্দেশনাহীন—দলের অনেকেই তখন ঘাতকদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। সামরিকতন্ত্রের বুটে পিষ্ট গণতন্ত্র। রুদ্ধ বাকস্বাধীনতা। অবিশ্বাস্য ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শোকে মুহ্যমান জাতি ছিল দিশাহারা। কিন্তু থেমে ছিলেন না জাতির জনকের দুই কন্যা। তাঁরা বিশ্বমানবতার কাছে বিচার চেয়েছিলেন ইতিহাসের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে প্রথম আবেদন রাখা হয় ১৯৭৯ সালের ১০ মে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার কাছে এই আরজি পেশ করেছিলেন কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।

বিশ্ব অঙ্গনে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি শেখ রেহানার

১৯৭৯ সালের ১০ মে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন

১০ মে ১৯৭৯। সেদিন স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সর্ব ইউরোপীয় নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে লন্ডনে অবস্থানরত শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোনকে বলেন সম্মেলনে যেতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি  টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

এটাই ছিল কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে শেখ রেহানার প্রথম বক্তব্য রাখা। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তিনিই সর্বপ্রথম পঁচাত্তরের কলঙ্কজনক ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তোলেন। সেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের পৈশাচিক বর্ণনা দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ রেহানার আবেগঘন বক্তব্য সে অনুষ্ঠানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। এখান থেকেই নতুন এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত পান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে বিলেতের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিএমপির কথা শেখ রেহানার মাথায় আসে। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশিষ্ট কৌঁসুলি ছিলেন এই ব্রিটিশ আইনজীবী। তাঁকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা পরিচালনা করা যায়। এ ব্যাপারে তিনি টেলিফোনে দিল্লিতে বড় বোনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের কনওয়ে হলে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। ড. শফিক সিদ্দিক সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন স্যার টমাস উইলিয়ামসের নাম, যা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি নেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ‘হাউস অব কমন্সে’ গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ রেহানা ও ড. শফিক। এবং তাঁকে জানান, বিদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করার লক্ষ্যে সম্প্রতি সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়েছে। এতে সভাপতি পদের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়েছে। ১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি থেকে লন্ডন যান। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন স্যার টমাস উইলিয়ামস শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। ওই সময় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করার দায়িত্ব নিতে তাঁকে অনুরোধ করেন। এতে তিনি সম্মত হন। কিছু দিন পর আবার স্যার টমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। সেদিন সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালিদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি প্রধান বক্তা ছিলেন। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে ড. কর্নরাড উড ও লেবার পার্টির দুজন পার্লামেন্ট সদস্য বক্তব্য দেন। টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করার ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন বলে শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দেন।

১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হাউস অব কমন্সের নিকটবর্তী কুন্দুন রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি, সদস্যরা হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইনবিষয়ক মুখপাত্র জেফরি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার অব্রে রোজ। অব্রে রোজকে কমিশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পক্ষে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে এই তদন্ত কমিশন গঠন ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরন্তর চেষ্টার ফসল।

১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের সদস্য জেফরি টমাস কিউসি এমপি ও সলিসিটার অব্রে রোজ বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেন। কিন্তু তাঁদের ভিসা মেলেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে জে. জিয়া জড়িত থাকা সম্পর্কে তথ্য চাপা দেওয়া সম্ভব হবে না বলেই তদন্ত কমিশনের সদস্যদের ভিসা নামঞ্জুর হয়। ১৯৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশের ভিসা নামঞ্জুর করার বিষয়টি হাউস অব লর্ডসে উপস্থাপন করেন, যা ৪ ফেব্রুয়ারি হাউস অব লর্ডসে আলোচিত হয়। ওই আলোচনায় তত্কালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যারিংটনসহ অনেকে অংশ নেন। ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রায় ছয় বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়ে গেলে দেশের প্রচলিত আইনে স্বাভাবিক পন্থায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসুল মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। এই বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালের এই দিনে।

এম. নজরুল ইসলাম, অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী লেখক ও সাংবাদিক।
কালের কণ্ঠ, ১০ মে, ২০১৭ লিঙ্ক

আরও পড়ুন