সেই খোকাই তো আমাদের দিয়ে গেছেন একটি সবুজ বাংলাদেশ

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

মা-বাবা তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। খুব বেশি আদরের সন্তানই বোধহয় ছিলেন। কিন্তু আদর-আনন্দে আর সুখে ভাসতে চাননি তিনি। তিনি চাইলে হয়তো হতেন তুখোড় একজন আইনজীবী। নিজেকে করতেন নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত, উজ্জ্বল। কিন্তু শুধু নিজেকে জ্বলজ্বল করে তোলবার জন্য তো তাঁর জন্ম হয়নি। তাঁর জন্ম হয়েছিল একটি স্বাধীন দেশ বির্নিমাণের জন্য। তাই শৈশব থেকেই তিনি পড়ার টেবিলে মুখ গুজে থাকেননি, থাকেননি নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত।

সততা আর সাহস নিয়ে শৈশব থেকেই নানা বন্ধুর পথ পেরিয়ে এসেছেন। কন্টক বিছানো পথকে করেছেন চলার সাথী। অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করাকে জীবনের মুখ্য কাজ মনে করতেন। ছিলেন লড়াকু। আর তিনি যদি এমনটা না হতেন-তবে কি আমরা আজ স্বাধীন দেশে বাস করতে পারতাম? তিনিইতো ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনের ড্রাইভিং ফোর্স। তিনি যেন জাদুকর। সকল অপশক্তিকে দূরে সরিয়ে ফেলার জন্য বাংলার জনগণকে এক কাতারে সামিল করেছিলেন।

তাঁর দরাজ ভরা গলার ডাককে কে উপেক্ষা করতে পারে, বলুন? তিনি পেরেছেন। আর পেরেছেন বলেই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদেরকে স্বাধীন দেশ দিতে গিয়ে নিজেকে মোমের মত পুড়িয়েছেন। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন জেলের ভিতরে। ‘তাঁর জীবনে এমন সময়ও গেছে যখন মামলার সাজা খাটা হয়ে গেছে, তারপরও জেলে বন্দি করে রেখেছে তাঁকে। এমনকি বন্দিখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন নাই, হয় পুনরায় গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছেন অথবা রাস্তা থেকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছেন’(কারাগারের রোজনামচা-পৃষ্ঠা-৫)।

জেলে থাকার সময় বন্দি জীবনযাপনের কাহিনী তিনি লিখেছেন ডায়েরিতে। তাঁর লেখা ডায়েরিতে তাঁর নিজের কষ্টের কথা আমরা পাই না, কিন্তু সামান্য একটা মুরগির মৃত্যু তাঁকে কতটা ব্যথিত করেছিল তার বর্ণনা পাই। যিনি সামান্য একটি প্রাণির মৃত্যুতে ব্যথিত হন, তিনি যে একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্র দেবার জন্য নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে তুচ্ছ করবেন তা বলাই বাহুল্য। তাঁর হাত ধরেই আমরা পেয়েছিলাম ৬ দফা, যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের জন্য মুক্তির সনদ, তাদের বাঁচার দাবি।৬ দফা কর্মসূচি থেকেই বোঝা যায় যে, নেতা হিসেবে ছিলেন তিনি কতটা প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি তর্জুনী উঁচিয়ে বলেন-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। একজন মানুষ একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে স্বল্প সময়ে কোনো পুনরুক্তি ছাড়াই একটি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।ভাষণে তিনি তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলেছেন। ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয়।

কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, “একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। এর মধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং। কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ বলতে পারে। অন্য কোনো ভাষণ এভাবে স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে মুখস্থ বলতে পারে বলে আমার জানা নাই। কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এটা অমর কবিতা। আর সেই কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হিংস্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। জাতি হিসেবে আত্মপরিচয় পেয়েছে। বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তিনি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য সে সময়েই নিয়েছিলেন নানা পদক্ষেপ যা একমাত্র দূরদর্শী নেতার পক্ষেই নেয়া সম্ভব। তার শাসনামলে প্রতিষ্ঠা হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, কুদরাত-ই-খুদা কমিশন। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতি যে কোনভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না- তিনি সেসময়েই ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর শাসনামলে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

ভাবতে ভাল লাগে যে, এক সময় যেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেখানে পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে আজ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪৯টি। বাংলাদেশে যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থাকবে তা এক সময় কয়জনই বা চিন্তা করতো? এখন আগের মত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার হিড়িকও নেই। আজ দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। এখন শুধু প্রয়োজন শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পরিকল্পনা- যার কাজ চলমান। আজকের বাংলাদেশের শিক্ষার যে প্রসার তার মূল ভিত্তি রচিত হয়েছে কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই।

তিনি শুধু শিক্ষায় নয় এই বাংলাদেশের অগ্রগতি কেবলই যেন এগিয়ে যায় তার জন্য সর্বক্ষেত্রে বীজ বুনে দিয়ে গেছেন। আর তা সম্ভব হয়েছিল কেবল তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে অকুতো সাহস, তাঁর নেতৃত্ব, কঠোর সংকল্প ও দূরদৃষ্টির কারণে। তাই তিনি হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। কিন্তু বড় দুর্ভাগা জাতি আমরা। পারিনি বাংলাদেশের স্থপতিকে ধরে রাখতে। তার খেসারতও বহুকাল আমাদের দিতে হয়েছে। মা বাবা যাকে ‘খোকা’ নামে আদর করে ডাকতেন, সেই খোকাই তো আমাদের দিয়ে গেছেন একটি সবুজ বাংলাদেশ, একটি লাল সবুজের পতাকা, একটি সংবিধান। কয়জন মানুষ এমন দিতে পারে বলুন?

জন্মশতবার্ষিকীতে এই বাংলার স্থপতি জাতির পিতার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

মৌলি আজাদ
জাগোনিউজ২৪.কম ১৭ মার্চ ২০২০ লিঙ্ক

আরও পড়ুন