সেই ভয়ঙ্কর ভোরেও গিয়েছিলাম বত্রিশ নম্বরের বাড়ির সামনে

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের আগে শুনেছিলাম কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ এবং মোহাম্মদ ফরহাদের নাম। কিন্তু সামনাসামনি প্রথম দেখেছিলাম শেখ মুজিবকেই। গত শতকের ষাটের দশকের প্রথমভাগে (১৯৬৪ সালে) পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ, তিনি ছিলেন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নার বোন। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহ প্রার্থী হওয়ায় অনেকে ভেবেছিলেন আইয়ুব হয়তো হেরে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তখন সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতো না। ভোট দিতেন পাকিস্তানের দুই অংশের ইউনিয়ন কাউন্সিলের ৮০ হাজার মেম্বার-চেয়ারম্যান। এদের অনেকেই আইয়ুব খান কিনে নিয়েছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল।

যা হোক, ওই নির্বাচনের একটি প্রচার সভায় ফাতেমা জিন্নাহ পাবনার ঈশ্বরদী এসেছেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমি পাবনার ভাঙ্গুরা বড়ালব্রিজে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ঈশ্বরদীতে যাওয়া এবং শেখ মুজিবকে প্রথম দেখা। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সব কিছু মনে নেই। কিন্তু শেখ মুজিবের চেহারাটা সেই যে মনের পর্দায় গেঁথে গেছে তা আর মুছে যায়নি বরং দিনকে দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। তিনি বক্তৃতায় কী বলেছিলেন তা মনে নেই। তবে তাঁর ভরাট গলার কথাগুলো যে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্বেলিত করেছিল, তা বেশ মনে আছে। ফাতেমা জিন্নাহ ভাষণ দিয়েছিলেন উর্দুতে আর শেখ সাহেব বাংলায়। ফাতেমা জিন্নার চেয়ে শেখ মুজিবকে নিয়েই উপস্থিত মানুষের বেশি আগ্রহ ছিল বলে আমার তখনই মনে হয়েছিল। সেদিন আমার আত্মীয় বলেছেন, শেখ সাহেব হলেন বাঙালির ভবিষ্যৎ। এই ‘ভবিষ্যৎ’ শব্দের অর্থেও আমার কাছে খুব স্পষ্ট ছিল না। আজ মনে হয়, আমার সেই আত্মীয় সেদিন ভুল বলেননি।

এরপর একের পর এক নানা ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনার জন্ম দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠতে থাকেন বাঙালির আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা মামলা বাতিল, শেখ মুজিবের মুক্তি, বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ – এসব কিছু যেন নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী ঘটে যায়। এর সবই যেন হওয়ার ছিল। কোনোটাই বাদ দেওয়ার মতো ছিল না বা না ঘটার মতো ছিল না। এই সময়কাল আমিও ক্রমে রাজনীতি-আগ্রহী হয়ে উঠি এবং বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ি। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা, তার গগনস্পর্শী জনপ্রিয়তা চোখের সামনে ঘটতে দেখি। কিন্তু এতে খুব খুশি হয়েছি তা বলতে পারবো না। আমাদের বাম রাজনীতির বড় ভাইদের কাছে শেখ মুজিবের খুব প্রশংসা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। বরং জয় বাংলা স্লোগান যখন মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে তখন আমরা অর্বাচীনের মতো জয় সর্বহারা, জয় সমাজতন্ত্র স্লোগান মানুষের কণ্ঠে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু লক্ষ করেছি, যারা সত্যকারের ‘সর্বহারা’ তারাও এই স্লোগানের সঙ্গে একাত্মবোধ করেননি, যেটা করেছেন জয় বাংলা স্লোগানে।

আমাদের এলাকাটি ছিল কমিউনিস্ট প্রভাবিত। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকলেও ন্যাপ, কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ের শক্তিশালী সংগঠন ছিল। গ্রামে গ্রামে কৃষক সমিতির সংগঠন ছিল। সে তুলনায় আওয়ামী লীগ ছিল না বলেই মনে হতো। সত্তরের নির্বাচনের সময় আমি উপলব্ধি করি, ন্যাপ নয়, আওয়ামী লীগই মানুষের পছন্দের দল। মণি সিংহ কিংবা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ নন, মানুষের নেতা হচ্ছেন শেখ মুজিব। শেখ মুজিব আর সব নেতাকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছেন, আর অন্য সবাই কেবল পিছিয়ে পড়ছেন। সত্তরের নির্বাচনের আগে শেখ সাহেব দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ-পঞ্চগড়ে জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। ঠাকুরগাঁ থেকে পঞ্চগড় যাওয়ার পথে বোদা হাইস্কুল মাঠের পাশে একটি পথসভায় কয়েক মিনিট কথা বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে তিনি সবাইকে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। শেষে বলেন, ‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি দেওয়ার কিছু নেই, বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই’। মানুষ যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলো। জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হলো। নির্বাচনের ফলাফল যেন নির্ধারিত হয়ে গেলো। আমি তখন দৈনিক আজাদ এবং কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘জাগরণী’ পত্রিকার সংবাদদাতা। শেখ মুজিবের জনসভার খবরের শিরোনাম করেছিলাম, ‘বুকভরা যাঁর ভালোবাসা’। এখন এতো বছর পরে এসে ভাবি, সেই অপরিণত বয়সেও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার বিবেচনায় কোনো ভুল ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় আমাদের বামপন্থিদের কারো কারো মধ্যে কিছুটা ঈর্ষা ছিল বলেই আমার মনে হতো। একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। সত্তরের নির্বাচনী প্রচারসভায় একজন বক্তা বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু তার জীবনের তেরোটি বসন্ত নষ্ট করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে’। বঙ্গবন্ধু যে অত্যাচার-নির্যাতন উপেক্ষা করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি বা বিচ্যুত হননি- সেটা বোঝানোর জন্যই কারাগারে তেরোটি বসন্ত নষ্ট হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। পরদিন একই স্থানে হয়েছিল ন্যাপের কুঁড়েঘর মার্কার প্রার্থীর জনসভা। আগের দিন আওয়ামী লীগের জনসভার বক্তৃতার জবাব দিয়ে অগ্নিকন্যাখ্যাত ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী মঞ্চে উপবিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা গুরুদাস তালুকদারকে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনাদের নেতার তেরোটি বসন্ত নষ্ট হয়েছে, আর আমাদের দলে এমন অনেক নেতা আছেন যাদের জীবনে বসন্তই আসেনি’।

উল্লেখ্য যে, গুরুদাস তালুকদার ৩০ বছরের বেশি জেলে অথবা আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। বামপন্থিদের ত্যাগ-তিতিক্ষা অবশ্যই কম নয়। কিন্তু তারা কেন মানুষের কাছে সেভাবে গ্রহণীয় হলেন না, সেটা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা বামপন্থিরা করেছেন বলে মনে হয় না। বরং বঙ্গবন্ধুই তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্তু তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত। এদের আমি বলতাম। জনসাধারণ চলছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা – ১০৯)

শেখ মুজিবের রাজনীতিতে পুরো আস্থা বামপন্থিরা রাখতে পারেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মানুষের নাড়ির টান যেভাবে বুঝতেন, বামেরা সেটা থেকে দূরে ছিলেন বলেই তারা কোনো বড় ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেননি। কমিউনিস্টা সাহসী ছিলেন না, এটা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে তাদের বাস্তব বোধের ঘাটতি ছিল। তারা সবকিছু যান্ত্রিকভাবে তত্ত্ব দিয়ে বিচার করতে গিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর যেমন ছিল সাহস, তেমনি ছিল জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা বা শক্তি। তাই তিনি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন পেয়েছেন আর কমিউনস্টরা থেকেছেন বিচ্ছিন্ন, দূরের মানুষ। শতভাগ বিশুদ্ধতা দিয়ে যে রাজনীতি হয় না, সেটা বঙ্গবন্ধু জানতেন, মানতেন। তবে মানুষকে ভালোবাসার দুর্বলতা তাকে রাজনীতির কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছো ১৯৭৫ সালে মার্চ মাসে। তখন বাকশাল হয়েছে। আমরা জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে জনতার ভালেবাসার জবাব দিচ্ছিলেন। ছাত্রদের মিছিলটি যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নেমে এলেন নিচে। হাত মেলালেন যতোজনের সঙ্গে সম্ভব। কোথায় প্রোটোকল, কোথায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি! মানুষের নেতাকে মানুষের কাছ থেকে দূর করতে পারিনি কৃত্রিম বেড়াজাল।

এর কয়েকদিন পর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেই জনসভায় উপস্থিত থেকে কাছ থেকে তাঁর ভাষণ সেদিন শুনেছিলাম। বঙ্গবন্ধু কেন বাকশাল করলেন, কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন, তার ব্যাখ্যা করলেন। গরিব দুঃখী মানুষের জন্য তার বেদনা-হাহাকার সেই ভাষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-মজুদদারি-মুনাফাখোরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

এরপর এলো সেই ভয়াবহ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু একাধিকবার বলেছেন, মানুষের ভালোবাসার ঋণ প্রয়োজনে বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবেন। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। ততোদিনে বাঙালি জাতিকে নিজের জীবন ছাড়া আর বেশি কিছু দেওয়ার ছিল না তাঁর। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে কী নিষ্ঠুর প্রতিদান পেলেন তিনি। ভালোবাসার সঙ্গে বুকে যদি তিনি একটু ঘৃণাও পুষতেন তাহলে হয়তো শত্রুর বিরুদ্ধে আরেকটু কঠিন হতে পারতেন! শত্রুমিত্র চেনা এবং শত্রুর শেষ না রাখা রাজনীতির এক কঠিন বাস্তবতা।
১৫ আগস্ট ভয়ঙ্কর ভোরেও আমি ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঘাতক বাহিনী ওই বাড়িতে আমাকে প্রবেশ করতে দেয়নি। দীর্ঘক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারার স্বস্তি সম্বল করে ফিরলাম বঙ্গবন্ধুহীন দুঃসহ এক বাংলাদেশে ।

বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জাগোনিউজ২৪.কম ১৭ মার্চ ২০২০ লিঙ্ক

আরও পড়ুন