বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই দিনব্যাপী ভারত সফরে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে হওয়া বৈঠকের বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফর করেন। তারা দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক এবং প্রতিনিধি দলের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখতে একমত হন। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এই সফরেই নিশ্চিত হয়, ২৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে।
২৫ মার্চের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার
ভারতের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, প্রতিবেশীসুলভ আচরণ ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। এক যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ২৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতের সশস্ত্রবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। বঙ্গবন্ধুর দুই দিনের সফর শেষে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয় বলে বাসস জানায়। বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর ভূমিকার জন্য দেশটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
বিবৃতিতে কী ছিল
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে সমতাভিত্তিক বাণিজ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থির হয় যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রাষ্ট্রভিত্তিক বাণিজ্য চলবে। দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জোটনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও সাধারণ মানুষের ন্যায্য ও গভীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপ দেওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে কাজ করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে তাদের সাক্ষাতের পর থেকে এ পর্যন্ত সবক্ষেত্রে সাধিত অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন তারা। সব রকমের বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী নীতি দ্বারা পরিচালিত দেশের সাধারণ মানুষের ন্যায্য ও গভীরভাবে অনুভূত আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপদানের সিদ্ধান্ত নেন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী।
দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ করেন যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছে এবং ৬ সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ উদ্বাস্তু দেশে ফিরেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সরকারের সম্ভাব্য সব রকমের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের পারস্পরিক কল্যাণকর অর্থনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করেন। সমতা ও পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা, পরামর্শ ও প্রতিনিধি দলের সফরের বিষয়ে তারা সম্মত হন। প্রয়োজনে উপযুক্ত সংস্থা গঠন, আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
বঙ্গবন্ধুকে ৩৬ রকমের উপহার
ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে ৩৬ ধরনের উপহার পান বঙ্গবন্ধু। পুনর্বাসন দফতর থেকে ৯৮৬ ধরনের যান উপহার দেওয়া হয়। এরমধ্যে তিনটি বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়, বাকিগুলো মার্চে বাংলাদেশে পৌঁছানো হবে বলে জানানো হয়। ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার পক্ষ থেকে দোতলা বাসের দুটো মডেল উপহার দেওয়া হয়। রাজভবনে তাকে রেশমি কাপড়ের ওপর জাতীয় সংগীতের পঙ্ক্তি লিখে উপহার দেওয়া হয়। রাজভবনে বঙ্গবন্ধুকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ ছায়াছবি উপহার দেওয়া হয়। সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য সেটি তৈরি করেছিলেন।
সফর শেষে দেশে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু ৮ ফেব্রুয়ারি দুই দিনব্যাপী সফর শেষ করে কলকাতা থেকে ঢাকা ফেরেন। কলকাতা থেকে সাংবাদিকের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী দৈনিক বাংলায় প্রকাশ করা হয়, বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ৩১ নম্বর রোডের ধারে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছেন। ফেরার আগে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের জন্য ভালোবাসা নিয়ে ফিরছি। কলকাতা থেকে বিমানবন্দরে ফিরে বঙ্গবন্ধু সোজা তার নিজ বাসভবনে যান।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খানের দখলদার বাহিনী এই বাড়ি থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং সেই বাড়ির ক্ষতিসাধন ও মালামাল লুট করে। ৮ তারিখ দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনার বিষয়বস্তু মন্ত্রিসভার সদস্যদের অবহিত করেন। খবরে বলা হয়, ৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে বঙ্গবন্ধু প্রায় দেড় ঘণ্টা তার সরকারি বাসভবনে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।
দালাল শিক্ষকদের ক্ষমা করা হবে না
ডাকসু আয়োজিত এক শোকসভায় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, দালাল শিক্ষকদের কোনও অবস্থাতেই ক্ষমা করা হবে না। যেসব দালাল শিক্ষক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল, তাদের ক্ষমা নেই। রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করে বলেন, ইতোমধ্যে তাদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িকে ঘিরে পরিকল্পনা
শিলাইদহ হবে বাংলাদেশের শান্তিনিকেতন। বঙ্গবন্ধু কলকাতা সফরে তার এই পরিকল্পনার কথা বলেন। কুষ্টিয়া জেলার এই কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি কাজে অনেক বছর কাটিয়েছেন। সেই জায়গায় তার স্মরণে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রাথমিক ঘোষণা কলকাতায় দেওয়া হয়।
বাংলা ট্রিবিউন, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২০ লিঙ্ক