বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু অভিন্ন। সকল অর্থেই তিনিই বাংলাদেশ। হাত বাড়ালেই তিনি ধরে ফেলতেন বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা আর বাঙালির কষ্ট। সারাটা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন বাঙালির অহঙ্কার। বাঙালির দুঃথ, বেদনা, আনন্দ, স্বপ্ন, সাহস নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। আর তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক বিরাট স্বপ্ন-কী করে বাঙালির ভাষা ও স্বপ্নকে এক সুতোয় গাঁথা যায়। ৭ মার্চ ১৯৭২। মাথা উচুঁ করে তিনি বাঙালির অন্তরের গহীনে থাকা দুঃখ, বঞ্চনা, অপমান, স্বপ্ন, সাধ, সংগ্রাম এবং আগামী দিনের গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের কথা এক নিশ্বাসে বলে ফেল্লেন। সেই অমর কবিতাই আমাদের জাতীয়তার উম্মেষের সুসংহত উচ্চারণ। সেই উচ্চারণেই নিহিত রয়েছে বাঙালির মুক্তির বার্তা। যিনি এই বার্তা এমন সংহতভাবে দিয়েছিলেন তাঁর জন্ম হয়েছিল। তখনকার দিনে টুঙ্গিপাড়া ছিল এক অজ’পাড়া গাঁ। শহরাঞ্চলের সাথে সংযোগের জন্য কোন সড়ক পথ ছিল না। নদী পথই ভরসা।
কলকাতা থেকে এ গাঁয়ে পৌঁছাতে কয়েকদিন লেগে যেত। তবুও তাঁর পড়ালেখায় প্রগতিশীল পিতার যথাযথ সমর্থন ছিল। অল্প বয়সেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততারও তিনি বিরোধী ছিলেন না। তাই, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করা সম্ভব হয়েছিল। এ সময়েই তিনি সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিরোধী তৎপরতায় ছাত্রদের সংগঠিত করেছিলেন।
গণমানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এ সময়েই তাঁর হাতে খড়ি। দেশ ভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি এবং তাঁর আশেপাশের রাজনৈতিক কর্মীরা সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সঙ্কট, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, এবং কেন্দ্রের সাথে রাজনৈতিক দূরত্বের কারণে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েন। তাঁরা দ্রুতই বুঝতে পারেন যে, ধর্মের নামে পাকিস্তান গঠনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মানুষকে রাজনৈতিকভাবে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের ব্যানারে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। এছাড়াও সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের আন্দোলনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে তাঁকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। এ জন্যে তাঁর কোন খেদ ছিল না। কখনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুকম্পা প্রার্থনা করেন নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে যুক্ত হয়েছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সংগ্রামে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তখন থেকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি না দেয়ার পাকিস্তানি চক্রান্তের বিরোধিতা করার কারণে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর থেকেই তিনি আরো গভীরভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং বার বার পাকিস্তান সরকারের গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হন।
সম্প্রতি প্রকাশিত সে সময়কার পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনি’ থেকে পাকিস্তানের পূর্ব অংশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর প্রবল আকাক্সক্ষা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে অধিকাংশ সময় কারাগারে থাকা অবস্থাতেও এমন ধারাবাহিক এবং আপোষহীন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এদেশের তরুণ সমাজ ও বৃহত্তর জনগণের সামনে গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। এরই ধারাবাহিকতায় সদ্যগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের (যা পরবর্তিতে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়েছিলো) সামনের সারির নেতা হিসেবে তিনি বিবেচিত হতে লাগলেন। প্রথমে একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করলেও তারুণ্যদীপ্ত ও পরিশ্রমী শেখ মুজিব তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক হতে পেরেছিলেন। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমেই তিনি এদেশের নিপীড়ত মানুষের মুখপাত্র হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয় অর্জনেও তিনি অন্যতম মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর গভীর চক্রান্তের ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ওই সরকারের তিনিই একমাত্র মন্ত্রী ছিলেন যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারণ বাঙালির প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছিল সেটা তিনিই সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা তথা বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্পটি আমাদের সবারই জানা। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠতম মূহুর্ত অবশ্যই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে দেয়া তাঁর কাব্যিক ভাষণের ক্ষণটি। ঐ ভাষণেই তিনি কার্যত স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন মুক্তির কথা। ওই ভাষণেই তিনি আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা কৌশলের পথনকশাও তুলে ধরেছিলেন। আসন্ন যুদ্ধের কথা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে। আর তাই দেশের মানুষকেও এই বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তাঁকে তৎক্ষণাত পাক বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও পুরো একাত্তর জুড়ে তাঁর দেখানো পথেই মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তাঁর সুযোগ্য সহনেতারা। তাঁকে সামনে রেখেই তাঁরা অগুণতি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে শামিল করতে পেরেছিলেন। ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকারের সর্বাত্মক সহায়তা এবং সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ও সরকারগুলোর অবদানের কথাও এক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিকামি মানুষের ওপর চালানো পাক বাহিনীর নৃশংসতার কারণে সারা বিশ্ব থেকেই চাপের মুখে পড়ে হানাদর পাকিস্তান সরকার এবং শেষ পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশের। পরবর্তীতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু এবং লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পা রাখেন তাঁর স্বপ্নের ভূমি বাংলাদেশে। সে সময় তিনি সত্যিই সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া নিজের দেশে ফিরে আসার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন। দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে তা লুকাতেও চেষ্টা করেননি। সেদিন তিনি সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে একটি শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির দেশে রূপান্তরিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দিনের শেষ ভাগে তিনি দেশে পৌঁছে বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে আসা লাখো মানুষকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে দ্রুত চলে যান রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রাজনীতির এই অমর কবি দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। সেখানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন কান্না ভেজা চোখে। এর দুদিন পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। সেদিন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনের। বারবার তিনি জনগণকে এবং প্রশাসনকে বাংলাদেশ পুনর্গঠন করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানিয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর পর দেশ যে একটা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে তা বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করে সাফল্য পাওয়ার যে সক্ষমতা এ দেশের জনগণের রয়েছে সে সত্যটিও তিনি জানতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত পথে তাদেরকে নিয়ে এগুনো খুবই সম্ভব। ১৯৭২ সালে প্রজাতন্ত্রের যে সংবিধান প্রস্তুত করা হয় সেখানেও তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শন প্রতিফলিত হয়। এ পথে দেশকে এগিয়ে নিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। নি:সন্দেহে তিনি সঠিক পথেই এগুচ্ছিলেন।
স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আমাদের রিজার্ভে তখন কোন বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। শতকরা আশি ভাগের মতো মানুষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্বের কল্যাণে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবকাঠামো এবং সত্যিকার অর্থে কোন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশের ভেতরে ও বাইরে বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তখন খাদ্য শস্যের ভয়াবহ সঙ্কট চলছিলো। ওই সময়টায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের সঙ্কটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও বঙ্গবন্ধুর সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আর এগুলো মোকাবিলার জন্য তাঁর হাতে সম্পদও ছিল খুব সীমিত। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ আমাদের বিরুদ্ধে বৈরি অবস্থানে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু এই অল্প দেশজ সম্পদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়েই ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশের অর্থনীতিকে তুলে আনতে পেরেছিলেন। তাঁর শক্তিশালি এবং অনুপ্রেরণাদায়ি নেতৃত্বের গুণে এদেশের মানুষও নিজেদের লড়াই করার শক্তির ওপর আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল অন্য রকম। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কাল রাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বহু সংখ্যক সদস্যসহ হত্যা করা হয়। থেমে যায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সম্ভাবনাময় অভিযাত্রা। পুরো জাতি যে সমতাভিত্তিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাঁর অবর্তমানে দেশ চলতে শুরু করে ঠিক তার বিপরীত দিকে। অবশ্যি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবার সঠিক পথে ফিরেছে। বহু কষ্টে তিনি সারা পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে হাজির করতে সক্ষম হয়েছেন। তবু আজও ভাবি যদি সমগ্র জাতির আকাঙ্ক্ষার বাতিঘর বঙ্গবন্ধুকে অকালে না হারাতাম তাহলে আজ আমরা আরও কতোটা পথই না এগিয়ে যেতে পারতাম।
তাঁকে হারাবার পর প্রায় ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। তবু আজও তিনি তাঁর কন্যাদের এবং আমাদেরকে চেতনার জায়গা থেকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন আমাদের বিস্ময়কর উন্নয়ন অভিযাত্রায়। অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই আয় বৈষম্য এখনো প্রকটভাবে উপস্থিত। এ কথাটি মেনে নিয়েও বলা যায় যে অন্তত ভোগ বৈষম্য আর না বাড়ার ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। সমাজের পাটাতনের নিচের দিকের মানুষও এখন খেয়ে পরে ভালোভাবেই বেঁচে আছেন। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের অনুসরণীয় সাফল্যের কল্যাণে সারা দেশের মানুষ তিন বেলা পেট ভরে খাচ্ছেন, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ক্যালরিটুকু পাচ্ছেন। কৃষির উন্নয়ন ছিলো বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের অন্যতম প্রধান মনযোগের জায়গা। তাঁর কন্যার শাসনামলেও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে কৃষি খাতকে। এ কথা তো জানা যে কৃষির উন্নতি হলে দারিদ্র্য বেশি হারে কমে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা প্রতিবেশি দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোর তুলনায় বেগবান থেকেছে। এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবেই একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছি। টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট পণ্যের পাশাপাশি সিরামিক ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো পণ্য রপ্তানিতে ধারাবাহিক সফলতা বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে সত্যিই বেগবান করেছে। এবং আমরা আশাবাদী যে, ‘ডেমোগ্রাফিক’ ও ‘ডেনসিটি ডিভিডেন্টে’র কল্যাণে বাংলাদেশের এই সাফল্যের ধারা আরও কয়েক দশক ধরে অব্যাহত থাকবে। আর এ সব কারণেই বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পটি এতোটা চমকপ্রদ। আর এর ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু।
এই প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দর্শন ও অনুশীলনের কিছু দিক এখানে আলোচনা করতে চাই। এই আলোচনার মূল মনযোগের জায়গায় থাকবে বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় শিল্পায়ন ও শিল্প খাতের টেকসই বিকাশ।
অতীত গৌরব থেকে নি:সৃত উন্নয়ন আকাক্সক্ষা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের বেশ আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে এবং বক্তৃতায় বহুবার ‘সোনার বাংলা’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার দেখা যায়। তিনি সব সময়ই ‘সোনার বাংলার’ গৌরব পুন:প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন এবং সে মতো কাজও করেছেন। ‘সোনার বাংলা’ তাঁর কাছে নিছক রাজনৈতিক কোন ‘বুলি’ ছিলো না। এই ভূখণ্ডের অতীত গৌরবের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই এই আকাঙ্ক্ষা তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল। তিনি জানতেন মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেই বাংলা ছিলো সম্পদে ভরপুর সমৃদ্ধ এক ভূখণ্ড। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, উর্বর জমি এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদ-নদীর কল্যাণে ব্যাপক কৃষি উৎপাদনের কারণে আমাদের এ ভূখণ্ডটি ছিল বিশ্ব খ্যাত। মসলিন, সিল্ক, তুলা, মসলা, এমন কি জাহাজ পর্যন্ত রপ্তানি করার জন্য এই ভূখণ্ডের নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। সে যুগে বাংলা ছিল প্রকৃত অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র। এ কারণেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন মান গ্রেট ব্রিটেনের জনগণের জীবন মানের সমতুল্য ছিল। বঙ্গবন্ধু এই গৌরবময় অতীত সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির যথাযথ সংগ্রামের মাধ্যমে অতীতের সেই গৌরবময় অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর তাই স্বাধীনতার বহু বছর আগেই তিনি তাঁর সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। আর সুযোগ পেলেই জাহিদুর রহিমকে দিয়ে অনেক সমাবেশেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটি গাওয়াতেন। নিশ্চিতভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি তিনি স্থাপন করেছিলেন স্বাধীনতার বহু আগেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শুরুর কয়েক বছরেই। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানকে (অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশকে) একটি ‘নব্য উপনিবেশ’ হিসেবেই দেখতে চাচ্ছিল। জনগণের প্রাণের নেতা এবং খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রাদেশিক মন্ত্রী পরিষদের একজন মন্ত্রী হিসেবে খুব কাছে থেকে শোষণের এই চিত্রটি তিনি দেখেছিলেন।
সমতার সংগ্রাম: ‘দুই অর্থনীতি’র প্রস্তাবনা অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই একচোখা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি বাংলাদেশকে (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে) ঠকিয়ে গেছে। এই বৈষম্যের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সদা সচেতন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে এই বৈষম্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মাত্রাও ছিল। আর তাই সে সময় তিনি পাকিস্তান সরকারের ‘ফেডারেল কন্ট্রোল অফ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাক্ট’-এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এই আইনের মাধ্যমে শিল্প খাতের নিয়ন্ত্রণ প্রাদেশিক সরকারকে পাশ কাটিয়ে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল বলে তিনি মনে করতেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সময়কালে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৫০টি বৃহৎ শিল্প ইউনিটের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ৪৭টি বৃহৎ শিল্প ই্উনিটের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র ২ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তানে কৃষির অধিকতর বিকাশের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তদানিন্তন কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য বেশি পরিমাণে বরাদ্দ দিচ্ছিল। বাংলাদেশের (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের) কৃষকরা অতি উন্নত মানের পাট উৎপাদন করতো। অথচ এই পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে যা আয় হতো তার শতকরা ৯০ ভাগই ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করার জন্য। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলোও তুলে দেয়া হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্প মালিকদের হাতে (যেমন: কর্ণফুলি পেপার মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল)। পাকিস্তানে তখন চলছিল কতিপয় তন্ত্র। প্রায় সব ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল ২২টি পরিবারের হাতে। আর পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন নিয়ে ঐ কতিপয়তন্ত্রের সমর্থক কেন্দ্রীয় শাসকরা মোটেও ভাবতো না।
বঙ্গবন্ধু এই ভয়াবহ বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন এ দেশে শিল্পের বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করতে। পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের একটি ন্যায্য অংশ যেন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) উদ্যোক্তা ও জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তিনি যথাসম্ভব দর কষাকষি করেছেন। প্রাদেশিক সরকারের শিল্প মন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রস্তাবনার সার-সংক্ষেপ এ রকম:
প্রাদেশিক সরকার আমদানির লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতা পাবে।
পাট, তুলা ও তৈরি পোষাকের মতো শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় স্থাপিত হবে পূর্ব পাকিস্তানে (অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে)।
সাপ্লাই এবং ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালকের একটি পৃথক কার্যালয় পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হবে।
শতকরা ৫০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে (আগে যাচ্ছিলো কেবল ১০ ভাগ)।
তাছাড়া, কেন্দ্রীয় চা বোর্ডের সভাপতি হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তান-ভিত্তিক চা শিল্পের বিকাশে তৎপর ছিলেন। সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে দর কষাকষিও করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবনা অনুসারে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ এ দেশীয় কর্তৃপক্ষের হাতে আসার কথা। পূর্বের প্রতি পশ্চিমের বৈষম্যের সূত্রগুলো খুঁজে বের করার জন্য তিনি এমন কি একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের প্রস্তাবও করেছিলেন। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠনও করেছিল। ওই কমিশনে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাঙালি অর্থনীতিবিদরা কাজ করেন এবং বঙ্গবন্ধু যে বৈষম্যের কথা এতো দিন বলে আসছিলেন তারই প্রতিধ্বনি করেন। কিন্তু এই কমিশনের প্রতিবেদনটি দ্রুতই হিমাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কথা রাখেনি। এ সবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন বাঙালির স্বাধিকারের লক্ষ্যে দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় জায়গায় ছিলো ৬ দফা দাবি। আর এই ৬ দফার মূল কথাই ছিল বৈষম্য দূরীকরণ। এ জন্য তাঁকে বারবার জেলে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তবুও তিনি সুদৃঢ় ছিলেন। কখনো আপোষ করেননি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই আন্দোলনের জেরেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত হন জেনারেল আইউব খান (তদানিন্তন স্বৈরশাসক)। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মূলত একজন রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ নন। তবুও তিনিই প্রথম পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দু’টি পৃথক অর্থনীতির প্রস্তাবনা হাজির করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে পনের’শ মাইলের ব্যবধান তা ভৌগলিক সত্য। কাজেই এই দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি আলাদা অর্থনীতির কোন বিকল্প নেই’। এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে অনিহা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
নতুন দেশ: সকলের জন্য শিল্পায়ন ও উন্নয়ন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন ভগ্ন দশায় থাকা অবকাঠামো, বিধ্বস্ত অর্থনীতি, লাখো ক্ষুধার্ত মানুষ এবং কঠিন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। উল্লেখ্য, শক্তিশালি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে আসছিল। তবুও তিনি আশা ছাড়েননি। আন্তর্জাতিক সহায়তার তিনি বিরোধী ছিলেন না। তবে আত্মসম্মানের বিনিময়ে তা গ্রহণে ছিল তাঁর অনিহা। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কী খাবে। বঙ্গবন্ধু তখন তাকে বাড়ির জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘আপনি বাইরে কী দেখতে পাচ্ছেন?’ করগিল বলেছিলেন- ‘সবুজ ঘাসের একটি সুন্দর উঠোন’। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘যদি আপনারা কোন ধরনের সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে আমার জনগণ এগুলো খাবে’। এমনি আত্মমর্যাদাশীল এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনেক শিথীল শর্তে ওই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেন- ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামীদিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’
তাছাড়া পরবর্তী সময়ে অন্য আরেকটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।’
এখান থেকেই বোঝা যায় যে বঙ্গবন্ধু যথাযথভাবেই কৃষি ও শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে কৃষি শুধু যে মানুষের খাবারের যোগান দিবে তাই নয়, বরং আরও বহু বছর এ দেশের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে থেকে যাবে। এছাড়াও দারিদ্র্য নিরসনের পাশাপাশি শক্তিশালি কৃষি খাত দেশের বর্ধিষ্ণু শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনিয় কাঁচামালের যোগান দিবে। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই বঙ্গবন্ধু দেশের কৃষির বিকাশের জন্য বেশ কিছু সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- যুদ্ধ বিধ্বস্ত কৃষি অবকাঠামো দ্রুত পুননির্মাণ, হ্রাসকৃত মূল্যে বা বিনা মূল্যে জরুরি ভিত্তিতে কৃষি যন্ত্রাদির সরবরাহ, বীজের যথেষ্ট সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পাকিস্তান আমলে কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, কৃষি পণ্যের জন্য সর্বোচ্চ ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য রেশন সুবিধা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের শুরুর দিকেই তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার এসব পদক্ষেপ নিয়েছিল। এসব পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন এ কারণে যে তিনি জানতেন কৃষি উন্নয়ন হলো টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
বঙ্গবন্ধু কৃষি ও শিল্প খাতের পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়েও ছিলেন সচেতন। যেমন: সার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ। তাই বঙ্গবন্ধু সারা দেশে সার কারখানা স্থাপন ও সেগুলো চালু করাকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে শিল্পায়নের কোন বিকল্প নেই। একদিকে শিল্পায়নের ফলে উৎপাদিত পণ্য দেশের ভেতরের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয় নিশ্চিত করে। অন্যদিকে শিল্প খাতে বর্ধিষ্ণু জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তবে সম্ভবত সদ্য স্বাধীন দেশে শিল্পায়নই ছিলো বঙ্গবন্ধুর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ তখন রিজার্ভ ছিলো শূন্য, কোন বিদেশি বিনিয়োগ ছিলো না, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজও ছিলো সামান্য এবং সর্বোপরি খুব অল্প লোকেরই প্রয়োজনীয় উদ্যোক্তাসুলভ দক্ষতা ছিলো।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই ছিলো উদ্যোক্তা-বান্ধব। তাই কিভাবে উদ্যোক্তাদের বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যায় সেদিকে সব সময় মনযোগ দিয়েছেন। আগেই যেমনটি উল্লেখ করেছি, এমন কি যখন প্রাদেশিক সরকারের শিল্প মন্ত্রী ছিলেন তখনও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। উদ্যোক্তাদের সময় বাঁচানো ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় দেশ ও দেশের বাইরের বিনিয়োগকারিদের পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছিলেন এবং তাদেরকে প্রাদেশিক সরকারেরর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সে সময় এ দেশে ব্যক্তি খাতের বিকাশের বাস্তবতা প্রায় ছিল না বললেই চলে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে তাই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প খাতের বিকাশের যথোপযুক্ত নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সকল পাকিস্তানি উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা-পয়সা ও অন্যান্য উপকরণ সাথে করে নিয়ে চলে যাওয়ায় স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু বড় বড় ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান, পাট ও চিনি কল এবং টেক্সটাইল কারখানা রাষ্ট্রিয়করণ করেছিলেন। পাকিস্তানি উদ্যোক্তা এবং ব্যবস্থাপকরা যখন টের পেয়েছিলেন যে এ দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে তখন তারা এমন কি গাড়িগুলোও পাকিস্তানে পাচার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সামাজিক সুবিচারে বিশ্বাসী ছিলেন। আর তাই এসব ব্যাংক-বীমা ও শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেবার ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্তটি তিনি নিয়েছিলেন। এবং এর প্রাথমিক ফলাফল ছিলো সত্যিই চমকপ্রদ। স্বাধীনতার প্রথম বছরের মধ্যেই দেশের পাটকলগুলো তাদের সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করতে শুরু করেছিলো। টেক্টটাইল মিল, কাগজ কল এবং সার কারখানাগুলোর জন্য এ অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো যথাক্রমে ৬০ শতাংশ, ৬৯ শতাংশ এবং ৬২ শতাংশ। সবগুলো কারখানাতেই পাকিস্তান আমলের চেয়ে বেশি বেশি উৎপাদন শুরু হয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ব্যবস্থাপনাগত দূর্বলতার কারণে শেষ পর্যন্ত এ ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
প্রাথমিক পর্যায়ে সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে শিল্প বিকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও, বঙ্গবন্ধুর মধ্যম ও দীর্ঘ-মেয়াদি পরিকল্পনা ছিল ব্যক্তি খাতের বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনাগুলোর দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মেলে। যেমন: ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়, এবং ব্যক্তি খাতের উদ্যোগে শিল্প কারখানা স্থাপনের সুযোগ রাখা হয়। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলেই পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ১৩৩টি কারখানা ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে ‘ডিরেগুলেশন’-এর প্রথম পর্যায় শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আমলেই। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন বাস্তববাদী নীতি-নির্ধারক। তাই পরবর্তিতে নিশ্চিতভাবেই তিনি সামাজিক সুবিচারের বিষয়টি মাথায় রেখে অর্থনীতির উদারিকরণের আরও উদ্যোগ নিতেন।
সঠিক পথে ফিরে আসা এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সুবিবেচনাভিত্তিক কৃষি ও শিল্প নীতির আলোকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অপশক্তি তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ থেকে সরে এসেছিলাম। বহু বছর এবং বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের পর আমরা আবার তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন অভিযাত্রার পথে আবার ফিরে আসতে পেরেছি। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সামনে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং উপর থেকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতির মূল সুর ঠিক করে দিচ্ছেন। তাঁর সহযোগি নেতৃত্ব এবং জনপ্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই মূল লক্ষ্যগুলোকে ছোট ছোট বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপে বিভক্ত করে সেগুলোর মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এই স্বপ্নময় অভিযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে তার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য আমাদেরকে পদ্মা সেতু, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বড় বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট, গভীর সমুদ্র বন্দর, মেট্রো রেল, রেলওয়ের উন্নয়ন, নদী পথের উন্নয়ন এবং সর্বোপরি ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের জন্য প্রয়োজনিয় ডিজিটাল অবকাঠামো প্রস্তুত করার মতো মেগা উদ্যোগগুলো সময় মতো বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদেরকে শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও বিশেষ মনযোগ দিতে হবে। কৃষির সকল উপখাতে যান্ত্রিকীকরণেও আমাদের বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের ব্যবহার এবং গবাদি পশু পালনে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে জোর দেওয়া দরকার। সর্বোপরি এসডিজিগুলো যথা সময়ে বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদেরকে কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে এবং একই সঙ্গে সৌরশক্তি ও বায়ু শক্তিসহ সকল ধরণের নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রসারের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। এসডিজি লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাত ও অলাভজনক সংস্থগুলোর সম্মিলিত ও সু-সমন্বিত উদ্যোগ উৎসাহিত করতে হবে। চীনে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে সমস্ত বিনিয়োগকারিরা চীন থেকে সরে আসছেন তাদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি ভারত, ভূটান, নেপাল ও বাংলাদেশ মিলে বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াতে কানেক্টিভিটির সুযোগগুলো বাড়াতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করাকে আরও সহজ করতে পারি, যাতে ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে আমরা আরও উন্নতি করতে পারি। এটা অনেকটা ‘প্রথম দর্শনে প্রেমে’র মতো ব্যাপার। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন কি-না তা তিনি দু’বার ভাববেন এমন আশা করা ঠিক হবে না।
দারিদ্র্র্য, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্রের অভাব, জনসম্পদের দক্ষতার ঘাটতির মতো কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমরা আশাবাদী যে একটি গতিশীল ও বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ হিসেবেই আমরা অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী পালন করতে পারবো। আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতিকে আমরা একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পেরেছি। এই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের যে স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা রাখি। তবে এ জন্য অবশ্যই সামাজিক-রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। এই মহা স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কেবল মাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই।
লেখক: ড. আতিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ, ২০১৯ লিঙ্ক