“পাকিস্তানের জিন্দানখানা হতে ১৯৭২-এর ৮ই জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি”
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনঃ
আমি এই মুহূর্তে আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই
ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দুটি বৈঠক করার পর তার প্রতিশ্রুতি রাখেন এবং ৮ই জানুয়ারি আগে থেকে পাকিস্তানে অবস্থানরত ডঃ কামাল হোসেনসহ বঙ্গবন্ধুকে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেন। বিমানটি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মধ্যে রাত তিনটায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। গোপনে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে ইসলামাবাদ ত্যাগের এই খবর সাংবাদিকরা জানতে পারেন ১০ ঘন্টা পর। লন্ডনে পৌঁছে ক্ল্যারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধু অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও জনসাধারণের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর বক্তব্যে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থনদানকারী মার্কিন জনগণ ও অন্যান্য জনসাধারণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীনতা, সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্যে অনুরোধ জানাবে।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বিশ্বাসঘাতকের কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্যে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনো প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকার করেন।
জনাব ভুট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্যে নিষপ্রদীপ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যেখানে আমাকে তারা কোন রেডিও, কোন চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে, তা জানতে দেওয়া হয় নাই।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এতো উচ্চমূল্য, এতো ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন দেশের মানুষকে ভোগ করতে হয় নাই। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতো, বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডে সেও লজ্জা পেতো। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যে কোন একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটি বিবেচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি তাঁকে বলেছি, আমার দেশবাসীর সাথে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোন কিছু বলতে পারবো না। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।
[সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও পূর্বদেশ; ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২]