পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর ১৬ ও ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এর জার্মান সংবাদপত্র দি ফ্রাঙ্কফোর্টার আলগেমাইন জাইতুংগ-এর বিবরণী আমাদের বুঝতে সহায়তা করে যে, শেখ হাসিনা সেখানে কী পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এ নিয়ে তৎকালীন জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র নোমান রশীদ চৌধুরী ২০১৪ সালে আমাকে সাক্ষাৎকার দেন।
‘বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যার খবরটি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্রথম পান জার্মান সময় রাত ৩টা ৩০ মিনিটে গিজেলা বন নামের ৬৫ বছর বয়সী একজন জার্মান সাংবাদিকের কাছ থেকে। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আসা টেলিফোন কল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে। শেষ কলটি আসে ভোর ৬টায় বেলজিয়ামে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের কাছ থেকে, যার বাসায় তখন শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও শেখ রেহানা অতিথি ছিলেন। তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ফোনে অনুরোধ করেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সম্মত হন। ঠিক করা হয় যে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবার ব্রাসেলস থেকে জার্মানি-বেলজিয়াম বর্ডারের আচেন আসবেন এবং হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাদেরকে কোনিগসউইন্টারে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য আচেনে দুটি গাড়ি পাঠাবেন। শেখ হাসিনা ও তার পরিবার স্থানীয় সময় সকালে ব্রাসেলস ত্যাগ করে আচেনের পথে রওনা হন এবং ১৫ আগস্ট বিকেলে সাড়ে ৪টায় কোনিগসউইন্টার পৌঁছেন। ১৫ আগস্টের সন্ধ্যায় ডয়েচে ভেলে, জার্মান ব্রডকাস্টিং অথরিটি এবং ফ্রাঙ্কফোর্টার এলগেমানই জাইতুংগের রিপোর্টার কোনিগসউইন্টারের বাড়িতে আসেন; কিন্তু হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ছাড়া কারও মন্তব্যই তারা নিতে পারেননি। প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শোকাভিভূত ছিলেন। পরিশেষে শেখ রেহানাকে নিচতলায় নেমে আসতে রাজি করানো হয় এবং তিনি গণমাধ্যমে যৎকিঞ্চিৎ কথা বলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বক্তব্য পশ্চিম জার্মান রেডিওতে প্রচার হয় এবং পরদিন ১৬ আগস্ট শনিবার ও ১৮ আগস্ট সোমবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
জার্মানিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নটি ওঠে। স্পষ্টত তারা বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবেন না। স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার অ্যাসাইলামের জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিরভাগ দেশেই অ্যাসাইলাম প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বনের একটি কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর প্রস্তাবে পশ্চিম জার্মানির ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বর্ষীয়ান পুরি বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। পরদিন পুরি বলেন, তাকে তার নয়াদিল্লির বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেতে হবে এবং অ্যাসাইলাম প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে। স্বাধীনতার আগে ও পরে কয়েক মাস নয়াদিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ করেছেন; কিন্তু এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। ১৮ আগস্ট তিনি কোনিগসউইন্টারের বাড়ি থেকে নয়াদিল্লিতে গান্ধীর অফিসে ফোন করেন। গান্ধী নিজে টেলিফোন কলটি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের দুর্ভাগ্যপূর্ণ অবস্থার কথা তিনি তাকে জানান এবং তাৎক্ষণিকভাবে গান্ধী ভারতে তাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন ও যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
জার্মানির একটি অভিজাত গবেষণা ফ্যাকাল্টিতে তখন ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ফেলোশিপ করছিলেন। তাকে সব কাজ গুটিয়ে ফেলতে হয়। তাদের কোনিগসউইন্টার ত্যাগ করার পর নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ওঠে। ফের গিজেলা বনকে যোগাযোগ করা হলে পরদিন ২০ আগস্ট জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে জার্মান ভূমিতে থাকাকালীন তাদের নিরাপত্তার আশ্বাসও মিলে যায়। অবশেষে জার্মান পর্ব শেষে, শেখ হাসিনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ রেহানা, জয় (সজীব ওয়াজেদ) ও পুতুল (সায়মা হোসেন) ২১ আগস্ট কোনিগসউইন্টার ত্যাগ করেন এবং একদিনেরও কম সময়ে দিল্লি পৌঁছান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের বেলজিয়াম বর্ডার থেকে বহনকারী গাড়ির চালক গভীর আবেগ ও যত্নে চার দশক আগের জার্মান সংবাদপত্রগুলো, যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী প্রেসমিটের সংবাদ ছাপা হয়, সেগুলো সংরক্ষণ করেন। সংবাদপত্রগুলো তার (বর্তমানে জার্মান প্রবাসী) ওই সংগ্রহ থেকে জেরক্স করিয়ে আনেন নোমান।
আসিফ কবীর, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির মিডিয়া পরামর্শক;
৩১ ডিসেম্বর ২০১, সমকাল লিঙ্ক