মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলন

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক এটি যেমন সত্য; তেমনি সত্য বঙ্গবন্ধুর জনসম্পৃক্ত উন্নয়ন ভাবনা। বঙ্গবন্ধুর এই জনগণমুখী উন্নয়ন ভাবনায় আমরা সমবায়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখতে পাই। আগামী বছর জাতীয় পর্যায়ে সাড়ম্বরে পালিত হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ : ২০২০-২০২১। আলোকিত মুজিববর্ষের প্রাক্কালে ২০১৯ সালের ৪৮তম জাতীয় সমবায় দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর দর্শন সমবায়ে উন্নয়ন’। আমরা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে সমবায় ও এর প্রাসঙ্গিকতা, বঙ্গবন্ধুর সমবায়ের দ্যোতনা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর সমবায় দর্শনের কার্যকর প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে প্রায়োগিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে ‘সমবায় আন্দোলন’কে জাতির পিতার ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ দর্শনকে ‘জাতির পিতার সমবায় বাংলা’য় কার্যকর করতে পারি। আর তা হলেই বাংলাদেশের উন্নয়ন মহাযজ্ঞে ‘সমবায় আন্দোলন’কে সম্পৃক্ত করে জাতির পিতার প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো হবে।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সমবায় একটি আন্দোলন ও চেতনার নাম একটি আদর্শ ও সংগ্রামের নাম। ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত হলেও সমবায় সমিতি কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নয়। সমবায় হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণের জন্য স্বেচ্ছায় সংগঠিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তি কর্তৃক গঠিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যা যৌথ মালিকানাধীন এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। সার্বিক বিচারে বলা যেতে পারে, সমবায় হচ্ছে তিনটি বল বা শক্তির সমষ্টি। এগুলো হলো জনবল, অর্থবল ও মনোবল। সম্পদ ব্যবস্থাপনাগত দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায় ‘সমবায় হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় পাঁচটি মূলধন ১. অর্থনৈতিক মূলধন; ২. মানবীয় মূলধন; ৩. সামাজিক মূলধন; ৪. প্রাকৃতিক মূলধন এবং ৫. ভৌত মূলধনের সঠিক ব্যবহারের হাতিয়ার। জাতির পিতা এই পঞ্চ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। আর তাই তো বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে দেশের উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালীগুলোর মালিকানার ক্ষেত্রে সমবায়ী মালিকানাকে রাাষ্ট্রের দ্বিতীয় মালিকানা খাত হিসেবে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

উন্নয়নের মহাসড়কে অগ্রসরমান বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সমবায় অধিদপ্তর সামগ্রিক পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে নবতর চেতনায় এগিয়ে যেতে চায়। সমবায় অধিদপ্তর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে সময়, চাহিদা ও প্রয়োজনের নিরিখে সমবায় অধিদপ্তরের সমবায় ভাবনাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে এবং নিম্নোক্ত সমবায় প্রত্যয় ঘোষণা করতে হবে : সমবায় অধিদপ্তর সমবায়ের সনাতন সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সমবায় সমিতিগুলোকে নতুন আঙ্গিকে দেখতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সমবায় অধিদপ্তর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সমবায় শুধু তাত্ত্বিক আদর্শভিত্তিক সনাতনী সংগঠন না হয়ে সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী উদ্যোগ আত্মস্থ করে নিজেরাই নিজেদের এলাকায় সর্বজনীন ও সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের একটি মজবুত সংগঠনে পরিণত হবে। সমবায় অধিদপ্তর প্রত্যাশা করে, বাংলাদেশের সমবায় স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদ গ্রহণ ও ব্যবহার করে বাংলাদেশের জনগণের সর্বজনীন ও সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের মজবুত সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমবায়ের সক্ষমতা ও আর্থ-সামাজিক দ্যোতনা প্রমাণ করবে।

সমবায় অধিদপ্তরের বর্তমানে চলমান এবং পূর্বে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর শিক্ষা থেকে সমবায় সেক্টরের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে

১. সমবায় অধিদপ্তরের বিদ্যমান দুগ্ধ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা নিয়ে সারাদেশে দুগ্ধ সেক্টরের উন্নয়নে চলমান প্রকল্পের পাশাপাশি নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং চরাঞ্চলে এসব প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগলপালন, হাঁস-মুরগিপালন ও মহিষ পালন প্রকল্প গ্রহণ করা।

২. ইতোমধ্যে বস্তবায়িত গারো প্রকল্পের অভিজ্ঞতায় দেশের অন্যান্য জেলায় এ ধরনর প্রকল্প গ্রহণ করা এবং তাদের পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমবায়ভিত্তিক ছোট ছোট প্রকল্প গ্রহণ করা।

৩. উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা এবং এর আওতায় প্রতিটি জেলায় বা বিভাগে শোরুম স্থাপন এবং মার্কেটিং লিংকেজ স্থাপন করা।

৪. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের জন্য প্রকল্পভিত্তিক কৃষি সমবায় সমিতি গঠন করা এবং গঠিত সমবায় সমিতির মাধ্যমে সদস্যদর মাঝে আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা।

৫. সমবায় আন্দোলনকে গতিশীল ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লি.সহ জাতীয় পর্যায়ের সমবায় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালীকরণের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৬. সমবায় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো (বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি বা আঞ্চলিক সমবায় ইনস্টিটিউটগুলো) ও মাঠ পর্যায়ের সমবায় অফিসগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য অবকাঠামোসহ আধুনিক সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রকল্প গ্রহণ করা।

৭. আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে সমবায় অধিদপ্তরের সব কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করা এবং সব সেবা অনলাইনে প্রদানের জন্য অধিদপ্তরসহ সমবায় সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা।

১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘… সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ সমবায় অধিদপ্তর বর্তমানে এই ‘আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি’র মোহনায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আছে জাতির পিতার সমবায় দর্শন ও প্রধানমন্ত্রীর সমবায় অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ নভেম্বর, ২০১৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৪৭তম জাতীয় সমবায় দিবস এবং জাতীয় সমবায় পুরস্কার ২০১৬ ও ২০১৭ বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছেন ‘সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমবায় সম্ভাবনাময় শক্তি। সমবায়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সমবায় সহায়ক শক্তি হতে পারে। দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমবায় একটি পরীক্ষিত কৌশল। (সমবায় বার্তা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যা)।’

জাতির পিতার সমবায় দর্শন এবং প্রধানমন্ত্রীর সমবায় অঙ্গীকারকে পাথেয় করে আমরা সমবায় আন্দোলনকে বাংলাদেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী পরীক্ষিত হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। আমরা আমাদের কথা-কাজ ও অঙ্গীকারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাই: ‘সমবায় সমিতি হচ্ছে সদস্যদের জন্য, সদস্যদের দ্বারা এবং সদস্যদের কল্যাণে পরিচালিত সংগঠন। (A Cooperative Society is the organization of the cooperators, for the cooperators and by the cooperators).’ জাতির পিতার সমবায় দর্শন ও উন্নয়ন এখানেই নিহিত রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অকুতোভয় ছিলেন। তিনি কোনো ভয়ভীতিতেই পিছপা হননি। দেশ ও জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল। বঙ্গবন্ধুর এই অবিচল জীবন সংগ্রামের নির্যাস নিয়েই আমরা ‘মুজিববর্ষ ২০২০-২০২১’ সার্থকভাবে উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনে নতুন মাত্রা আনতে পারব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

হরিদাস ঠাকুর : সমবায়-গবেষক ও চিন্তক। যুগ্মনিবন্ধক ও উপাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি, কোটবাড়ী, কুমিল্লা।

আমাদের সময়, ২ নভেম্বর ২০১৯,লিঙ্ক

আরও পড়ুন