১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের বছর ১৯৭৬ সালের পত্রিকায় ৭ মার্চ নিয়ে কোনও সংবাদ পাওয়া না গেলেও ১৯৭৭ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার এক কলামে ‘আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংবাদটি পুরো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরো সংবাদে বঙ্গবন্ধুর নামকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও সংবাদে উল্লেখ রয়েছে— এই দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান করার বিষয়, এছাড়াও রয়েছে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রসঙ্গও। কিন্তু এই আহ্বান যিনি দিয়েছিলেন, যার বজ্রকণ্ঠে এই বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, তার নামটিই অনুচ্চারিত থেকে যায় পত্রিকায়।
অন্যদিকে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সংবাদে ৭ মার্চ ও ৮ মার্চ দুটি সংবাদের উপস্থিতি দেখা যায়। উল্লেখ করার মতো বিষয়টি হলো, ৭ মার্চের মহাত্ম্য নিয়ে তেমন কোনও বিষয় পত্রিকাটির সংবাদে উঠে আসেনি। প্রতিবেদনে স্থান পায় আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা আয়োজনের বিষয়টি।
যদিও ৮ মার্চের দৈনিক সংবাদ পত্রিকা আওয়ামী লীগের আলোচনা সভার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত করে। এই সংবাদে যাদের বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন— অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শওকত আলী, ডা. মেজবাহউদ্দিন বাচ্চু, মোহাম্মদ হানিফ, মনসুর আহমেদ, আবদুল মান্নান, এম এ আওয়াল এবং ন্যাপের প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যে ৭ মার্চ নিয়ে মূল্যায়নধর্মী মন্তব্য স্থান পেয়েছে কিন্তু ওই সংবাদের কোথাও বঙ্গবন্ধুর নামটি লেখা হয়নি।
১৯৭৮ সাল: পত্রিকায় ফিরলো বঙ্গবন্ধুর নাম
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ‘আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। এই সংবাদের প্রথম অংশেই উল্লেখ করা হয়— ‘আজ হইতে সাত বৎসর পূর্বে এইদিনে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ সংগ্রামী জনতার সম্মুখে সেদিনের সর্বাপেক্ষা প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানাইয়া ছিলেন।’
অন্যদিকে, দৈনিক সংবাদে ‘৭ মার্চে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালন হবে’ এই সংবাদটি পাওয়া যায়। পরে ৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কর্মসূচির প্রতিবেদন থাকলেও তাতে বঙ্গবন্ধুর নাম ছিল না।
১৯৭৯ সাল: ৭৫সালের পর পত্রিকায় আবারও যুক্ত হলো ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি
১৯৭৮ সালে শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান নামটি ব্যবহার হলেও ১৯৭৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাক প্রথমবারের মতো শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু উপাধি যুক্ত করে সংবাদ ছাপে— ‘আজ হইতে ৮ বৎসর আগে একাত্তরের এই দিনটিতে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের রক্তচক্ষু, বুলেট ও বেয়নেটকে উপেক্ষা করিয়া মুক্তিপাগল লক্ষ জনতাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে উদাত্ত আহ্বান জানাইয়া ছিলেন।’
দৈনিক সংবাদও ৭ মার্চের সংবাদে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিবুরের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু উপাধিও যুক্ত করে। ওই সংবাদে উল্লেখ করা হয়— ‘সেদিনের এই নির্ভীক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাসে শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, হানাদার বাহিনী কবলিত সারা বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের বুকে জুগিয়েছে সাহস, দিয়েছে পথনির্দেশ ।’
১৯৮০ সাল: প্রথমবারের মতো ভাষণ প্রচারের আহ্বান এবং ‘জাতির জনক’ উল্লেখ
১৯৭৯ পর্যন্ত ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কিছুটা আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের আহ্বান জানানো হয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বরাত দিয়ে। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’ শিরোনামে প্রথম পাতায় একটি সংবাদ ছাড়াও তৃতীয় পাতায় পাওয়া যায় ‘৭ই মার্চ পালনের আহ্বান’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘আওয়ামী যুবলীগের (আমু) সভাপতি জনাব আমির হোসেন আমু এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব ফকীর আবদুর রাজ্জাক সভা, সেমিনার, গণজমায়েত, মিছিল ও ‘বঙ্গবন্ধু’র ভাষণ প্রচারের মাধ্যমে ৭ই মার্চ পালন করার জন্য সংগঠনের শাখাসমূহ ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন।’
অন্যদিকে, সবচেয়ে এগিয়ে ছিল দৈনিক সংবাদ। প্রথম পাতায় আলাদাভাবে বক্স করে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়— ‘একাত্তর সালের এই দিনে দেশ ও জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে ঔপনিবেশিক শক্তির কুটিল চক্রান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সকল সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের ডাক দেন।’ দৈনিক সংবাদ ৭ মার্চ উপলক্ষে ‘৭ই মার্চ, ইতিহাসের গর্বিত দিন’ শিরোনামে সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করে।
এরশাদ আমল: ১৯৮৪-৮৫ সালে ৭ মার্চ নিয়ে কোনও সংবাদ প্রকাশ হয়নি
সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর টানা দুবছর অর্থাৎ ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে ৭ মার্চ সংক্রান্ত কোনও সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে সংবাদপত্র, প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীরা ৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে এবং ১৩ মার্চ পর্যন্ত তা পালন করে। এসময়ের মধ্যে কোনও সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়নি।
১৯৮৫ সালে ৭ ও ৮ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংবাদ পর্যালোচনা করে ৭ মার্চ বা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি।
১৯৮৬: এ বছরও ৭ মার্চকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা
১৯৮৬ সালে ৭ মার্চ নিয়ে কোনও আলাদা প্রতিবেদন ছিল না দৈনিক ইত্তেফাকে। তবে এ উপলক্ষে সেদিন বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশের খবর প্রথম পাতায় ছবিসহ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে সমাবেশটিকে ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে’ উল্লেখ করলেও পুরো প্রতিবেদনজুড়ে ৭ মার্চ বিষয়ে আরও কোনও তথ্য ছিল না। কেবল ওই সমাবেশে ড. কামাল হোসের বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে এক জায়গায় বলা হয়, ‘গণশক্তির কাছে কোনও শক্তিই টিকে না, উহার প্রমাণ ১৯৭১-এর বঙ্গবন্ধুর সমাবেশ ও ঐতিহাসিক ভাষণ।’
দৈনিক সংবাদ সেদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপার পাশাপাশি প্রথম পাতায় এক কলামে ৭ মার্চ উপলক্ষে স্টেডিয়াম গেটে অনুষ্ঠিত গণজমায়েতের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, ‘‘আজ ৭ই মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সমাবেশে ঘোষণা করেন— ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ সংবাদের ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সেদিন আওয়ামী লীগ প্রতিটি ইউনিয়নে ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করে।’’
দৈনিক বাংলা এবছর প্রথম পাতায় ৭ মার্চ নিয়ে আলাদা কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। প্রথম পাতায় কেবল আওয়ামী লীগের কর্মসূচির প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো ‘আওয়ামী লীগ ও বাকশাল আজ ৭ই মার্চ পালন করবে’। প্রতিবেদনে পত্রিকাটি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি না লিখে তারা ‘মরহুম শেখ মজিব’ লেখে। উল্লেখ্য, প্রতিবেদনে ৭ মার্চের তাৎপর্য নিয়ে একটি লাইনও লেখা হয়নি।
১৯৮৭: ফিরতে শুরু করে ৭ মার্চের খবর
এবছর দৈনিক ইত্তেফাক ঐতিহাসিক এই দিবসটি সম্পর্কে “আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু উপাধিসহ তার নাম লেখা হয় এবং ৭ মার্চের ভাষণ থেকে উদ্ধৃতিও দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদনে আরও লেখা হয় ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ভাষণ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান প্রেরণা।’
দৈনিক সংবাদ এদিন ‘আজ ৭ই মার্চ: বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচী’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে। যদিও ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করা হয়নি। সেই সঙ্গে ৭ মার্চের তাৎপর্য বিশ্লেষণেরও কোনও প্রয়াস ছিল না। ৮ মার্চ পত্রিকাটি আরেকটি খবর প্রকাশ করে, যেটির শিরোনাম ছিল— ‘বাকশাল ৭ই মার্চের স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে।’ ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করা হয়।
দৈনিক বাংলা এবছর ৭ মার্চের কর্মসূচি ঘোষণার খবর প্রকাশ করলেও সেই খবরে বঙ্গবন্ধু বা ৭ মার্চের কোনও তাৎপর্য আলোচনা করেনি। একই পত্রিকায় অন্য একটি প্রতিবেদনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি দিয়ে ৭ মার্চ সম্পর্কে একটি লাইন লেখা হয়। যদিও সেখানে বঙ্গবন্ধু উপাধিটি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
দৈনিক আজাদ এবছর দিবসটি নিয়ে প্রথম পাতায় আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৭ মার্চকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়।
১৯৮৮ সাল: বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ৭ মার্চের খবর প্রকাশ
এরশাদ আমলে এবছর প্রথমবারের মতো দৈনিক ইত্তেফাক বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ৭ মার্চের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথম পাতায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু ও ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
দৈনিক সংবাদও এবছর ৭ মার্চ বিষয়ক প্রতিবেদনে এর নিয়ে তাৎপর্য আলোচনা করে। ১৯৮০ সালের পর আবারও পত্রিকাটি এই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবেও উল্লেখ করে।
দৈনিক বাংলা পত্রিকাটি এবছরে ‘৭ই মার্চ উপলক্ষে আজ ৮ দলের জনসভা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবছরেও তারা বঙ্গবন্ধু উপাধি লেখা থেকে বিরত থাকে। সেই সঙ্গে ৭ মার্চের তাৎপর্য নিয়েও কোনও ধরনের আলোচনা করেনি পত্রিকাটি।
দৈনিক আজাদ এদিন খবরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের তর্জনি উত্থিত ছবিও প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে ৭ মার্চের তাৎপর্য আলোচনা করা হয়।
১৯৮৯ এবছর দৈনিক ইত্তেফাক প্রথম পাতায় মর্যাদার সঙ্গে ৭ মার্চের খবর প্রকাশ করলেও কোনও ছবি প্রকাশ করেনি।
দৈনিক বাংলা এবার আলাদা করে ৭ মার্চের খবর প্রকাশ করেনি। কেবল ৭ মার্চ পালনের জন্য শেখ হাসিনার আহ্বানের খবর প্রকাশ করে তারা। যদিও ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ ছিল না।
এ বছর দৈনিক সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে ছবি সহ ৭ মার্চের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
১৯৯০
এবছর দৈনিক ইত্তেফাক আগের বছরের মতো গুরুত্ব দিয়ে৭ মার্চের খবর প্রকাশ করে।
তথ্য সংগ্রহ: বাংলা ট্রিবিউন গবেষণা বিভাগ
বাংলা ট্রিবিউন ১৭:১৬, মার্চ ০৭, ২০১৯ লিঙ্ক