মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো যেখানে পড়ে সে জায়গাটি জ্বলজ্বল করে। পাশেই অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও এমন কেউ কেউ থাকেন, যাঁদের আলোয় মঞ্চ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাদা চোখে সে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। তেমনই একজন মানুষ শেখ রেহানা। আজ ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখানে তাঁর ওপরও আলো পড়ার কথা। কিন্তু নিজেকে সে আলো থেকে সযত্নে শুধু নয়, সচেতনভাবেই সরিয়ে রেখেছেন তিনি। কিন্তু কেন? কারণ তাঁকে স্পর্শ করেনি কোনো মোহ। যেন এক অন্তর্গত মানুষ হিসেবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, বড় বোন শেখ হাসিনার রাজনীতিতে যোগদান, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো তাঁকেও সমানভাবে আলোড়িত করবে—এটাই স্বাভাবিক। আর কে না জানে, রাজনীতির অন্য রকম এটা টানও থাকে। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজনীতির পথটিই তিনি বেছে নিতে দ্বিধা করবেন না—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সরল সমীকরণটি তিনি বিবেচনায় না এনে বেছে নিলেন আটপৌরে গার্হস্থ্য জীবন। আপাতত এ চিত্রটিই উন্মুক্ত সবার সামনে।
জগৎ-সংসারে এমন কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা নিজেদের নিয়ে কখনো উদগ্রীব হননি। আবার পাদপ্রদীপের আলোয় কখনো নিজেদের আলোকিত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আড়াল করে রেখেছেন সব কিছু থেকে। এমন নির্মোহ থাকা সবার জন্য সম্ভব হয় না। বিশেষ করে রাজনৈতিক আবহে যাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁদের পক্ষে নিভৃত জীবন কাটানো একেবারেই অসম্ভব বলেই মনে করা হয়। তবে নিতান্ত সাদামাটা জীবনে যাঁরা অভ্যস্ত, ক্ষমতা তাঁদের মোহভঙ্গের কারণ হতে পারে না কখনো। এমনই এক আড়ালচারী মানুষ শেখ রেহানা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ কন্যা। জ্যেষ্ঠা শেখ হাসিনা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি জাতির জনকের আদর্শের পতাকা হাতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কঠিন ব্রত সাধনায় রত।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান শেখ রেহানা। বেড়ে ওঠা রাজনীতির আবহে। জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছেন বাড়িতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠা-বসা। কিন্তু নিজে এড়িয়ে চলেন সব ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ। আড়ালে থেকেই মানুষের কল্যাণ কামনা করেন সব সময়। এই কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা তো হয়েছে পারিবারিক সূত্রেই। এই আড়ালচারিতা তাঁর মাহাত্ম্যকে একটুও ম্লান করেনি। বরং পাদপ্রদীপের আলোয় না এসেও তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে চলেছেন তা তুলনারহিত। মিতবাক এই নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার সেবায়। তাঁর সেই নীরব নিবেদন সাদা চোখে সবার গোচরে আসে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পরিবারটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, সেই পরিবারের সব সদস্যই যে রাজনীতিসচেতন, তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্পৃক্ত হওয়ার সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আড়াল করে রাখার মধ্য দিয়ে যে নির্মোহ জীবনাচারের পরিচয় পাওয়া যায়, তা অতুলনীয়। পাদপ্রদীপের আলোয় আসার আকাঙ্ক্ষা সবারই থাকে। ইতিবাচক আলোচনার কেন্দ্রে থাকার ইচ্ছা দমন করা সহজ কাজ নয়। তার জন্য সাধনার প্রয়োজন হয়। সেই সাধনায় উত্তীর্ণ এক নারী শেখ রেহানা।
আমরা যদি একটু আলাদা করে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানার অবদান একেবারে কম তো নয়ই, বরং উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেপথ্যে আরো একজনকে পাওয়া যায়, যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য লাভ ছিল প্রায় অসম্ভব। শেখ রেহানা তেমনই একজন, যিনি সব সময় বড় বোনের পাশে থেকেছেন, তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন। প্রবাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সব সময় তাঁকেই পেয়েছে কাণ্ডারি হিসেবে।
শেখ রেহানা থাকেন লন্ডনে। নিতান্তই সাধারণ জীবনযাপন করেন। অথচ অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল তাঁর জীবন। জাতির জনকের কন্যা তিনি। রাজনীতির চড়াই-উতরাই দেখেছেন খুব কাছ থেকে। জীবনের শুরু থেকেই বলতে গেলে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। এ সময়গুলোতে তাঁর পরিবারকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। শেখ রেহানা খুব কাছ থেকে দেখেছেন কিভাবে তাঁর মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একা সামলেছেন সব ঝড়ঝাপ্টা। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের শীর্ষ নেতার পরিবারটিও আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ছিল। সেখানে মনের দৈন্য ছিল না। বরং আড়াল থেকে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার শিক্ষা তিনি পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকেই পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্বান্ধব পরবাসে নিজেদের মতো করে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাও তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। অভ্যস্ত করেছে পরিমিত জীবনাচারে। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সেই অনুভব করতে হয়েছে শূন্যতা। যে শূন্যস্থান পৃথিবীর কোনো সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কাউকে তা বুঝতে দেননি। বরং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন আত্মার আত্মীয়দের। যে কথা তিনি এক সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেছেন। তিনি গৃহকোণচারিণী কিন্তু গৃহসীমানার মধ্যে সংকুচিত নয় তাঁর জীবন। ঘরে ও বাইরে সমানভাবে চিরায়ত কল্যাণী তিনি। সর্বক্ষেত্রে তিনি অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। সত্যনিষ্ঠায় সুদৃঢ় থেকেছেন। মিথ্যাকে আশ্রয় করেননি। সত্যের নির্মলতম আদর্শ রক্ষা করেছেন সব সময়। নিজের ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তোলার ব্যাপারে আপস করেননি। মিথ্যা সুবিধার ভোগবাদিতায় আকৃষ্ট হননি। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করেছেন।
প্রকৃতিই বোধ করি তাঁকে আদর্শ এক মানুষে পরিণত করেছে। জীবনের যে সময় উচ্ছলতায় ভেসে যাওয়ার কথা, তখনই পেয়েছেন সবচেয়ে বড় আঘাত। এর পর থেকেই তো শুরু হয়েছে জীবন-সংগ্রাম। যে সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি তাঁর। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাঁরা সবাই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
তাঁকে রাজনীতিবিমুখ ভাবার কোনো অবকাশও কিন্তু নেই। রাজনীতি যাঁর রন্ধ্রে তাঁকে কি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে রাখা যায়। তিনি নেপথ্যের একজন হয়ে গেলেন, প্রকাশ্যে না এসেও সম্পৃক্ত হলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। তিনিই তো প্রথম মানুষ, যিনি প্রবাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছিলেন ১৯৭৯ সালের ১০ মে। দেশের প্রয়োজনে সব সময় তিনি পাশে থেকেছেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তিনি প্রবাসী নেতৃত্বের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন। সাহস জুগিয়েছেন। লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আমরা জানি, এখনো তিনি আছেন বড় বোনের পাশে ছায়ার মতো।
শেখ রেহানা সত্যের নির্মলতম আদর্শকে রক্ষা করেছেন। আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি। সত্যকে তিনি ভয় করেননি। মিথ্যার সুবিধা ভোগে প্রবৃত্ত হননি কোনো দিন। আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশ নামের জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতির দুই কন্যার জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। সেই বদলে যাওয়া জীবনধারায় খাপ খাইয়ে নেওয়া শেখ রেহানা নিজেকে গড়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। নিজের অতীত তিনি বিস্মৃত হননি। যদিও এত কিছুর পরও তিনি আড়ালে রেখেছেন নিজেকে। নিজের বড় বোন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, টানা তিনবারসহ চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেখ রেহানা এক আশ্চর্য শক্তিবলে এই পরিচয়ের গণ্ডির বাইরে রেখেছেন নিজেকে।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই তাঁকে। শুভ জন্মদিন।
লেখক :এম নজরুল ইসলাম, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি
কালের কণ্ঠ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ লিঙ্ক